শনিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০২১

মহামানব গৌতম বুদ্ধ (পর্ব২)দীপংকর বুদ্ধের সাক্ষাৎ

 



এভাবে সুমেধ তাপস অভিজ্ঞাশক্তি অর্জন করে হিমালয়ে সমাপত্তিসুখে অবস্থানকালে জগতে দীপংকর নামে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর মায়ের গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ, জন্ম, সম্বোধিলাভ ও ধর্মচক্র প্রবর্তনের সময় দশ হাজার চক্রবাল কম্পিত, প্রকম্পিত ও আন্দোলিত হয়ে মহাশব্দে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এবং বত্রিশ প্রকার পূর্বনিমিত্ত দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সুমেধ তাপস গভীর সমাপত্তিধ্যানে মগ্ন থাকায় সেই মহাশব্দ শোনেননি, আর সেসব নিমিত্তও (লক্ষণ) দেখেননি।

সে সময় দীপংকর বুদ্ধ চার লক্ষ আস্রবহীন শিষ্যসহ বিচরণ করতে করতে ‘রম্যক’ নামক নগরের উপকণ্ঠে সুদর্শন মহাবিহারে অবস্থান করছিলেন। রম্যনগরবাসীগণ শুনল যে, শ্রমণশ্রেষ্ঠ দীপংকর পরম সম্বোধি লাভ করে ধর্মচক্র প্রবর্তনের পর ক্রমান্বয়ে ভ্রমণ করতে করতে তাদেরই নগরের কাছে সুদর্শন মহাবিহারে বাস করছেন। এই খবর শুনে তারা তখন ঘি, মাখনাদি ওষুধ এবং সুন্দর আচ্ছাদন, সুগন্ধি দ্রব্য, ফুল-বাতি ইত্যাদি যাবতীয় পূজার সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে প্রগাঢ় শ্রদ্ধাসহকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘমনা হয়ে বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হলো এবং বন্দনা ও পূজার সামগ্রীগুলো নিয়ে পূজা করে সবাই একপাশে বসল। বুদ্ধ তাদের ধর্মোপদেশ দানে তৃপ্ত করলে সবাই আসন হতে উঠে বুদ্ধকে আগামী পরদিনের জন্য নিমন্ত্রণ করে নিজ গ্রামে চলে গেল।

পরদিন সেখানকার সব নাগরিক এক মহাদানযজ্ঞের আয়োজন করে নগরীকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে তথাগতের আগমন-পথ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করল। বর্ষাকালীন জলস্রোতে রাস্তার ভাঙা অংশ এবং অসমতল কিংবা কাদাময় স্থানগুলো নতুন মাটি দিয়ে সমতল করে তাতে সাদা রঙের বালু ছিটাতে লাগল। তার ওপর লাজ-ফুল ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন কাপড়ের ধ্বজাপতাকা উত্তোলন করল। এ ছাড়াও স্থানে স্থানে কলাগাছ রোপণ ও মঙ্গলঘট স্থাপন করল। সে সময় সুমেধ তাপস আশ্রম হতে বের হয়ে আকাশপথে যাবার সময় নিচে কর্মব্যস্ত উল্লসিত জনতাকে দেখে শিগগিরই আকাশ হতে অবতরণ করে জনগণকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘বন্ধুগণ, কোন ভাগ্যবান পুরুষের আগমন উপলক্ষে তোমাদের এই বিরাট আয়োজন?’

প্রত্যুত্তরে লোকজন তাঁকে বলল, ‘প্রভু সুমেধ, আপনি কি জানেন না যে দীপংকর বুদ্ধ সম্যক সম্বোধি লাভ করে ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছেন? সম্প্রতি তিনি দেশ পর্যটন করতে করতে আমাদের নগরসীমায় সুদর্শন মহাবিহারে বাস করছেন। আজ আমরা তাঁকে নিমন্ত্রণ করেছি। তাঁর আগমন উপলক্ষেই রাস্তাঘাট সংস্কার ও সাজানো হচ্ছে।’ এই কথা শুনে তাপস ভাবলেন, “বুদ্ধ উৎপন্নের কথা দূরে থাকুক, ‘বুদ্ধ’ এই শব্দ শোনাও জগতে অতি দুর্লভ। সুতরাং এই জনগণের সঙ্গে সংস্কারকাজে আমারও অংশগ্রহণ করা অবশ্যকর্তব্য।” এই চিন্তা করে তিনি জনগণকে অনুরোধ করে বললেন, ‘মহাশয়গণ, আপনারা যদি সম্যকসম্বুদ্ধের আগমন উপলক্ষেই এই সংস্কারকাজে আত্মনিয়োগ করে থাকেন, তা হলে অনুগ্রহ করে আমাকেও সেই পুণ্যের একজন অংশীদার করুন। আপনাদের সঙ্গে আমিও এই সংস্কারকাজে আত্মনিয়োগ করব।’

তারা আনন্দসহকারে সেই প্রস্তাবে সম্মত হলো। তারা জানত যে, এই সুমেধ তাপস হচ্ছেন মহা অলৌকিক শক্তিধর। তাই তারা তাঁকে এক কাদাযুক্ত স্থান দেখিয়ে বলল, ‘ভন্তে, আপনি এখানটি সমতল করে সুন্দরভাবে সাজান।’ সুমেধ তাপস ‘বুদ্ধ’ ‘বুদ্ধ’ বলে বুদ্ধকে উপলক্ষ করে প্রীতি উৎপন্ন করে ভাবলেন, আমি ইচ্ছা করলে রাস্তার এই ভাঙা-অংশটুকু আমার অলৌকিক শক্তিবলে অল্প সময়ে অনায়াসে সংস্কার করতে পারি। কিন্তু তাতে আমি তৃপ্ত হব না। বরং আজ আমি কায়িক শ্রমের দ্বারা কাজটি সম্পন্ন করে বুদ্ধের সেবা করব। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি নিজ হাতে মাটি আহরণ করে সেই অংশটি সংস্কার করতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর কাজ শেষ হবার আগেই মারজিৎ দীপংকর মহামুনি ষড়ভিজ্ঞ, সমদর্শী এবং বিগতমল চার লক্ষ ক্ষীণাস্রব শিষ্যসহকারে রাস্তায় পৌঁছে গেলেন। দেবমনুষ্যগণ আমোদিত হয়ে তাঁকে আগু বাড়িয়ে নিল এবং নানাপ্রকার ভেরিনিনাদে গগনমণ্ডল মুখরিত করে সাধুবাদ দিতে লাগল।

তখন দেবতারা মানুষদের আর মানুষেরা দেবতাদের দেখতে পাচ্ছিল। তারা উভয় পক্ষই করজোড়ে তথাগত বুদ্ধের অনুগমন করছিল। দেবগণ দিব্য তূর্যধ্বনি আর মানুষেরা মানুষিক তূর্যধ্বনি করতে করতে মহামুনি দীপংকর বুদ্ধের অনুগমন করছিল। দেবতারা আকাশ থেকে দিব্য মন্দার ফুল, পদ্ম ফুল ও পারিজাত ফুল চারদিকে ছিটিয়ে দিচ্ছিল। মানুষেরা পৃথিবী থেকে চম্পক, কুসুম, কদম, নাগেশ্বর, পুন্নাগ, কেতকী ও পদ্ম শাপলা ইত্যাদি ফুল ওপরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছিল।

এমতাবস্থায় সুমেধ তাপস অনন্যোপায় হয়ে নিজের হিত চিন্তা করে মনে মনে বললেন, ‘বুদ্ধের জন্য প্রয়োজনে আমি নিজের জীবনও বিলিয়ে দিতে পারি। তাই তিনি যাতে কাদায় না পড়েন, সেই ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে। আমি কাদায় শুয়ে পড়ব, আর চার লক্ষ আস্রবহীন অর্হৎসহ বুদ্ধ আমার পিঠের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবেন। এতে করে আমার ভাবী মঙ্গল হবে।’ এই ভেবে তিনি তাতে সেতুর মতো করে শুয়ে পড়লেন।

তিনি শায়িত অবস্থায় বুদ্ধের অপূর্ব বুদ্ধশ্রী অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে ভাবতে লাগলেন, ‘এখন আমি ইচ্ছা করলেই সব ক্লেশগুলো ধ্বংস করে সংঘভুক্ত হয়ে এদের সঙ্গেই রম্যনগরে প্রবেশ করতে পারি। কিন্তু জনসাধারণের অজ্ঞাতসারে চার আর্যসত্য ধর্মকে প্রত্যক্ষ করে আমি তৃপ্তি লাভ করতে পারব না। বরং আমি দীপংকর বুদ্ধের মতো সর্বজ্ঞতা লাভ করে অসংখ্য দেবমানবকে ধর্মনৌকায় তুলে নিয়ে ভবদুঃখ থেকে ত্রাণ করব। পুরুষোত্তম দীপংকর বুদ্ধের কাছে কৃত আমার এই শ্রেষ্ঠ কর্মের বিপাকে সর্বজ্ঞতা লাভ করে অসংখ্য প্রাণীকে মুক্ত করব। সংসারস্রোত ছিন্ন করে এবং কাম, রূপ ও অরূপ, এই ত্রিভবের কর্মক্লেশ ধ্বংস করে আর্য-অষ্টাঙ্গিক-মার্গরূপ ধর্মনৌকায় তুলে দেবমনুষ্যগণকে মুক্ত করব।’—অপদান অর্থকথা


শেয়ার করুন

Administrator: হিমেল বড়ুয়া

যদি(কিছু_জানো){ জানাে(); }নয়তো{ জানো();