চট্টগ্রাম, ২২ জুন ২০২৪: একসময় ইটভাটায় কঠোর পরিশ্রম করা উক্যমং মারমা অংসিং এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পছন্দের ফিন্যান্স বিভাগে ভর্তি হতে যাচ্ছেন। অভাব-অনটন আর প্রতিকূলতাকে জয় করে তার এই অর্জন অসংখ্য মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাউখালীর বেতবুনিয়ার পশ্চিম সোনাইছড়ি গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম অংসিংয়ের। নিজেদের জমি নেই, বাবা দিনমজুর আর মা গৃহিণী। পরিবারের বড় ছেলে অংসিংকে অন্যের বাড়িতে বেড়ে উঠতে হয়েছে। দশম শ্রেণিতে থাকাকালীন তিনি মাকে হারান, এরপর বাবাকেও যেতে হয় জেলে। দু'মুঠো ভাতের জন্য কখনো ইটভাটায়, কখনো রেস্তোরাঁয় কাজ করেছেন।
২০২১ সালে অভিমান করে নানির বাড়ি থেকে পালিয়ে চট্টগ্রামের রাউজানে ইটভাটায় কাজ নেন অংসিং। দিনে ৪০০ টাকা মজুরিতে তার পড়াশোনার ইতি টানার উপক্রম হয়। তবে প্রতিকূলতা তাকে দমাতে পারেনি। এসএসসি-তে জিপিএ ৫ পেয়ে তিনি প্রমাণ করেন তার মেধা। এরপর মামার সহযোগিতায় চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে ভর্তি হলেও, শহরে টিকে থাকার জন্য থালাবাসন মাজার কাজ নেন একটি রেস্তোরাঁয়। মাসে ছয় হাজার টাকা বেতনে কাজ করতে গিয়ে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারতেন খুব কম।
এইচএসসির টেস্ট পরীক্ষার আগে যক্ষ্মা ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১৩ মাস শয্যাশায়ী ছিলেন অংসিং। অর্থাভাবে চিকিৎসা না পেয়ে তাকে নিদারুণ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। বাবাও দ্বিতীয় বিয়ে করে আলাদা হয়ে যান। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সহায়তায় বিনামূল্যে যক্ষ্মার ওষুধ পেয়ে সুস্থ হওয়ার পর তিনি আবার পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার পড়াশোনা ছেড়ে সংসারের হাল ধরার কথা বলা হলেও, তিনি তার লক্ষ্যে অবিচল থাকেন।
২০২৪ সালে আবার এইচএসসি পরীক্ষা দেন অংসিং। এবার কোচিং বা বই কেনার সামর্থ্য না থাকায় বাড়িতে বসেই তিনি প্রস্তুতি নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন ফি জোগাড় করতে ঢাকায় এসে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। এরপর ঢাকার উত্তরায় একটি রেস্তোরাঁয় থালাবাসন মাজার কাজ নেন। সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ডিউটি করে, তিনি প্রতিদিন রাত ১টা থেকে ভোর ৪-৫টা পর্যন্ত রেস্তোরাঁর সিঁড়িতে বসে পড়াশোনা করতেন।
অংসিং বলেন, "কারো কথায় কান না দিয়ে এভাবেই পড়তে লাগলাম। ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ এলাকার সিনিয়রদের খুঁজে বের করতাম। তাঁদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিসংক্রান্ত নানা পরামর্শ নিতাম।" তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'গ' ইউনিটে মেধাতালিকায় ২৫৩তম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'বি' ইউনিটে ৩৭৩তম স্থান অর্জন করেন। ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় ২০ হাজার টাকা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় জোগাড় হয়েছে।
অংসিং এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্স বিভাগে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে চলেছেন। ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার মতো দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানোর দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেছেন তিনি। তার এই জীবনযুদ্ধ এবং অদম্য প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে সমাজের অনেক তরুণকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখাবে।