Editorial লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Editorial লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০২৩

শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমার তাৎপর্য

শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমার তাৎপর্য

 

শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমার তাৎপর্য


প্রতিসন্ধি গ্রহণ

বারাণসীর প্রায় পঞ্চাশ ক্রোশ উত্তরে নেপাল প্রদেশে রোহনী নদীর তীরে অবস্থিত কপিলাবস্তু নগরী। সেখানে রাজত্ব করতেন শাক্য বংশীয় রাজারা।মূলত শাক্য বংশীয়রা ইক্ষাকু বংশের বংশধর। ইক্ষাকুবংশীয় অম্ব নামে এক রাজার চারপুত্র ও চার রাজকন্যা রাজ্য থেকে নির্বাসিত হয়ে কপিলাবস্তুতে বাস করতেন।

রাজপুত্র ও রাজকন্যারা পরবর্তীতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী রূপে জীবনযাপন করতেন।

একসময় তাঁদের বংশবিস্তার হলো। তাঁদের বংশধরেরাই পরবর্তী সময়ের শাক্যবংশ, তাই কপিলাবস্তুর শাক্যেরা ইক্ষাকুবংশীয় বলে পরিচয় দেন।

শাক্য বংশের পূর্বসূরী রাজা জয়সেনের ছিল এক পুত্র সিংহহনু এবং এক কন্যা যশোধরা। সিংহহনুর চার পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। শুদ্ধোদন, অমৃতোদন, ধৌতধন, শুক্লোদন। দুই কন্যা যথাক্রমে অমিতা ও প্রমিতা। রোহনী নদীর অপর পরবর্তী দেবদেহ নামে স্থানে রাজা অনুশাক্যের কন্যা ইন্দ্রাণীর মতো রূপবর্তী মহামায়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ধার্মিক ও পুণ্যবান রাজা শুদ্ধোদন। দীর্ঘ সাংসারিক জীবনে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ না করায় রাজপ্রসাদের সুখ আর আনন্দ তাঁদের স্পর্শ করতে পারত না। সন্তানের মুখে মা ডাক শুনার জন্য মায়ের ব্যাকুলতা আর বংশের হাল ধরে রাখার জন্য পিতার উৎকণ্ঠা সর্বদা রাজপ্রসাদে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু উপায় কি। কর্মের বিধান পাল্টায় কে ! রাজা রাজশক্তি প্রয়োগ করে রাজ্যশাসন কিংবা রাজ্যদখল করতে পারেন। কিন্তু পিতার আসন লাভ করা তার চেয়েও দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। রাজা-রানীর মনে হতাশার অন্ত ছিল না।

এদিকে পৃথিবীতে অনাচার ছড়িয়ে পড়ল। দানবের প্রচণ্ড থাবায় মানবতা যেন বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। কে জাগাবে তাকে। বিপন্ন মানবতা। মানবপুত্র গৌতম বুদ্ধ তখন ৫৭ কোটি ৬০ লক্ষ বৎসর ব্যাপী তুষিত স্বর্গে বাস করছিলেন। মানবতার এই নাজুক অবস্থা দেখে দেবকুল শংকিত হয়ে পড়লেন। ত্রিশ প্রকার পারমী পরিপূর্ণ জগতের ভাবী সম্যক সম্বুদ্ধের নিকট দেবগণের আকুল প্রার্থনা ‘হে দেবাতিদেব, পৃথিবী আজ অনাচারে পরিপূর্ণ, চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি রব, মানুষ আজ পথভ্রষ্ট, দিন দিন মার শাসন আর মারের উৎপাত প্রকট হয়ে উঠছে, দানবের শ্বাসরুদ্ধকর ঘরে মানবতা আজ অবরুদ্ধ, বিপন্ন মানবতা আর মুমূর্ষ ধরা বাঁচাতে ত্রিলোকের কল্যাণে আপনি মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করুন। ’ ভাবীবুদ্ধ তাদের প্রার্থনা স্বীকার করলেন। কথা দিলেন, ‘আমি কপিলাবস্তুর ধার্মিক রাজা শুদ্ধোধনের ঔরষে এবং পূণ্যবতী রানী মহামায়ার গর্ভে জন্মধারণ করে ত্রিলোককে মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত করব। ’ সময় হতাশাগ্রস্ত রাজ-রানীকে আরো ব্যাকুল করে তুলল। কিন্তু না, এবার রানী মহামায়ার এক বিচিত্র স্বপ্ন দর্শন সমস্ত হতাশাকে বিদূরিত করে কপিলাবস্তুর কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলেন স্বপ্নপুরীতে। চারদিকপাল দেবতা পালঙ্কসহ তাঁকে তুলে নিয়ে গেলেন অনবতপ্ত হ্রদের তীরে। দেবতারা তাঁকে সপ্তযোজন উচুঁ সমতল ভূমির উপরে এক মহাশাল বৃক্ষের নিচে রেখে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। দেবপত্নীরা এসে রানীকে উক্ত হ্রদে ম্লান করিয়ে স্বর্গীয় ভূষণে অলংকৃত করলেন। চারদিক পাল দেবতারা রানীকে সুবর্ণময় প্রাসাদের দিব্যশয্যায় শয়ন করালেন। তারপর এক দিব্যকান্তি মহাপুরুষ শ্বেতহস্তীর রূপ ধারণ করে স্বর্ণময় পর্বত থেকে শুড়ে একটি শ্বেতপদ্ম নিয়ে অবতরণ করলেন। স্বেতহস্তীটি রানীর শয্যা তিনবার প্রদক্ষিণ করে তাঁর দক্ষিণপার্শ্ব ভেদ করে মাতৃজঠরে প্রবেশ করলেন। রাতের সেই অভিনব স্বপ্ন দর্শনের কথা তিনি মহারাজ শুদ্ধোধনকে জানালেন। রাজা রানীর শ্রীমুখ দিয়ে স্বপ্ন কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। রাজা এই সকল অলৌকিক স্বপ্নের কারণ জানতে চৌষট্টিজন বিখ্যাত জ্যোতিষীকে ডেকে আনলেন। জ্যোতিষীরা ভবিষ্যদ্বাণী করে বললেন, ‘রানী সন্তানসম্ভবা। আপনার রাজপুরী আলোকিত করে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করবে। এ ভাবী শিশু সংসারি হলে রাজচক্রবর্তী রাজা হবেন। আর সংসার ত্যাগ করলে সম্যক সম্বুদ্ধ হবেন। ’ তুষিত স্বর্গ থেকে চ্যুত হয়ে বোধিসত্ত্ব এভাবে আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিকে রাণী মহামায়ার গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন।

গৃহত্যাগ

সিদ্ধার্থ ছোট বেলা থেকেই চিন্তাশীল ছিলেন। সুযোগ পেলেই ধ্যান-মগ্ন হয়ে যেতেন। অফুরন্ত ভোগ সম্পদের আতিশয্যে তার জন্ম হলেও তিনি ক্রমশ সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠলেন। সংসারের প্রতি সিদ্ধার্থের বিতৃষ্ণাভাব এবং উদাসীনতা দেখে পিতা রাজা শুদ্ধোধন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রাজার একান্ত অভিপ্রায় রাজপুত্র সিদ্ধার্থ রাজচক্রবর্তী রাজা হউক। চার দ্বীপমালা বেষ্টিত জম্বুদ্বীপের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করুক। অনেকটা তোড়জোড় করে ঊনিশ বছর বয়সে রাজকুমার সিদ্ধার্থকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা হলো কোলীয়রাজ দণ্ডপাণির রূপসী কন্যা, পতিব্রতা, নারী ধর্মের মর্যাদার মূর্তি যশোধারার সাথে। পূর্ণ হলো রাজা শুদ্ধোধনের মনের কামনা। কিন্তু না ! জন্ম যার বিশ্বকল্যাণে তিনি সংসার বাঁধনে বাধা থাকবেন কি করে! মোহ! সে তো ভোগীদের বাঁধন। ত্যাগীর সামনে দাঁড়াবে কি করে! ছোটবেলা থেকেই যিনি জীব ও জগৎ নিয়ে চিন্তামগ্ন তিনি রাজপ্রাসাদের নরম বিছানায় পড়ে থাকবেন কি করে! একদিন তিনি নগর ভ্রমণে যাওয়ার কথা বললেন পিতাশ্রীকে। কথাটি শুনে রাজার মনে হলো যেন ঘাঁয়ের উপর বিষফোঁড়া। রাজপ্রাসাদের ভোগ বিলাসের আতিশয্যে থেকেও যে জীবনের দুঃখমুক্তির কথা ভাবে সে কি না যাবে নগর ভ্রমণে! কিন্তু উপায় কি। সব তো পারমী আর দৈবলীলা। ঠেকায় কে? রাজার মহাজ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা মনে আরেক বার নাড়া দিয়ে গেল। রাজা হ্যাঁ বলতে বাধ্য হলেন। কিন্তু চেষ্টা তো চালিয়ে যেতে হবে। রাজা অমাত্যদের কড়া নির্দেশ দিলেন কোনো জরাগ্রস্থ, ব্যাধিগ্রস্থ, মৃতব্যক্তি ও সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী যাতে রাজকুমারের চোখ না পড়ে। অমাত্যরা তাদের ঠেকালেন। কিন্তু দেবরাজকে কে সামলাবে? সিদ্ধার্থ সারথি ছন্দককে নিয়ে রথে করে প্রথম বার গেলেন পূর্ব দিকে। কিছুদূর যেতে না যেতেই চোখে পড়ল এক জীর্ণশীর্ণ জরাগ্রস্থ ব্যক্তি। সিদ্ধার্থ চমকে উঠলেন। আরে সারথি থাম! থাম! সিদ্ধার্থের আত্মবিচলিত জিজ্ঞাসা-কোটরে পড়ে যাওযা দুটি চোখ, শরীর থেকে দুলে পড়েছে খসখসে চামড়া, কংকালের মতো অবয়ব, লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইনি কে? বেচারা সারথি ছন্দক নিরুপায়। না বলে যে উপায় নেই। ‘প্রভু, তিনি আমার আপনার মতো রক্তমাংসের গড়া একজন মানুষ। তার রূপ, যৌবন, শক্তি সামর্থ্য সবই ছিল। কিন্তু কালের স্রোত তাকে আজ এখানে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে। ’ সে এমনটি হতে চায় নি। সময় এবং জাগতিক বিধান তাকে এরকম করেছে। তার মা, বাবা, স্ত্রী, পুত্র, ঘর সংসার সবই আছে। রাখ! রাখ! সারথি আর নয় অনেক হয়েছে। আগে বল আমিও তার মতো হব কিনা। সারথির সহজ সরল প্রতি উত্তর- হ্যাঁ প্রভু, এটাই সংসারের ধর্ম। সেদিন আর নগর ভ্রমণ হলো না। মনে অনেক প্রশ্ন অনেক কষ্ট নিয়ে ফিরে গেলেন রাজমহলে। দ্বিতীয় বার বের হলেন দক্ষিণ দিকে। কিছু দূর যাওয়ার পরে সামনে পড়ে গেল এক ব্যাধিগ্রস্থ ব্যক্তি। একেবারে ক্ষীণপ্রাণ। যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। তার সর্বাঙ্গে মৃত্যুর ছাপ ভর করছে। না পারছে বাঁচতে না পারছে মরতে। তাকে দেখে সিদ্ধার্থ আরো বেশি বিচলিত হয়ে পড়েলন। সারথি ছন্দক বুঝিয়ে দিলেন তাকে জীবনের করুণ দুর্দশার কথা। সেদিন আর নগর ভ্রমণ হলো না, ভারাক্রান্ত মনে ফিরে গেলেন রাজপ্রাসাদে। তৃতীয়বার বের হলেন পশ্চিম দিকে। হঠাৎ চোখে পড়ল এক করুণ দৃশ্য। চারজন লোক কাঁধে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তিকে। ব্যক্তিটির কোনো সাড়া শব্দ নেই। তার পেছনে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলেছেন কিছু নারী-পুরুষ। তাদের বুকফাটা বিলাপে বেজে উঠছে প্রিয়হারার কান্নার সুর। সারথি বুঝালেন জীবনের শেষ পরিণতির কথা। যাকে বলে মৃত্যু। সিদ্ধার্থের ব্যাকুল প্রশ্ন মৃত্যু কি? সারথি বুঝানের চেষ্ঠা করলেন, জন্ম-মৃত্যু ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়। ঈশ্বর কে? জীব ও জগতের সৃষ্টিকর্তা। অর্থাৎ জীবের সুখ-দুঃখের কারক। তিনি মেনে নিতে পারলেন না সারথির যুক্তিকে। রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন, চিন্তায় বিভোর হয়ে গেলেন, খেতে, বসতে, চলতে, শুতে সর্বক্ষণ নগর ভ্রমণের ভয়ানক করুণ স্মৃতিগুলো তার চোখের পর্দায় ভেসে উঠে। তাকে বিচলিত করে তোলে।

চতুর্থ বার বের হলেন উত্তর দিকে। অনেক দূর গেলেন। কিছুই পড়ছে না সামনে। সারথির মনে কত দুশ্চিন্তা। এবার সামনে কি পড়ে কি জানি। সৌম্য শান্ত গৈরিক বসনধারী ভিক্ষাপাত্র হাতে অধঃদৃষ্টিতে ধীরমন্থর গতিতে এগিয়ে আসছেন কুমার সিদ্ধার্থের রথের দিকে এক সন্ন্যাসী। আহা! কি প্রশান্তি! তাঁর চোখে মুখে নেই কোনো কষ্টের ছাপ। তাঁকে দর্শনে মনে প্রশান্তি জেগে উঠল। ‘সারথি, ইনি কে ? সিদ্ধার্থের ভাবগম্ভীর প্রশ্ন। তিনি সংসারত্যাগী এক সন্ন্যাসী। ’ তাঁর উদ্দেশ্য কি? সংসারের যাবতীয দুঃখমুক্তির উপায় অন্নেষণে তিনি সন্ন্যাসী সেজেছেন। সারথির এই কথাগুলো সিদ্ধার্তের খুবই মনপুত হলো। নগর ভ্রমণের ইচ্ছা আর বেশিদিন স্থায়ী হল না। অনেকটা কৌতুহলী মনে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন। শান্ত সৌম্য ওই সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থের মনের ভাবনায় জোয়ার এনে দিলেন। রাজমহলের নরম বিছানা, ভোগ-বিলাস, আমোদ-প্রমোদ কিছুই সিদ্ধার্থকে রমিত করতে পারছে না। ওই দিকে রাজকুমারের নগর ভ্রমণের প্রতিদিনের খবর রাজা রাখতেন। সব ঘটনা রাজাকে রীতিমত ভাবিত করে তুললেন। কুমার সিদ্ধার্থ পিতাকে সংসার ত্যাগের ইচ্ছা নিবেদন করলেন। যেন আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ল। রাজা অনেকটা নির্বাক হয়ে পড়ল। রাজা সংসারের সুখ এর বর্ণনাচ্ছলে পুত্রকে সংসারে বেঁধে রাখতে চাইলেন। কেউ কাউকে ছাড়ছেন না। অবশেষে পুত্র পিতার কাছে বর চেয়ে বসলেন। ‘পিতাশ্রী, জরা, ব্যাধি, মুত্যু যেন আমাকে স্পর্শ না করে। আমার এই রূপ যৌবন যেন চির অটুট থাকে। আমি যেন চির অমর হতে পারি। ’ পিতার নিরাশ উত্তর- ‘বৎস, আমি কেন পৃথিবীর কোনো পিতাই তার সন্তানকে এই বর দিতে পারে না। তুমি আমার রাজ্য, রাজত্ব চাও আমি তোমাকে এখনই দিয়ে দেব। ’ ‘না পিতাশ্রী, আমার এসব কিছুর প্রয়োজন নেই। আমি চাই দুঃখমুক্তি। ’ রাজা সর্বদা নাচে-গানে, আমোদ-প্রমোদে পুত্রকে মাতিয়ে রাখতে ব্যর্থ চেষ্ট করতেন।

একরাতে কুমার সিদ্ধার্থ ঘুমে মগ্ন হয়ে আছেন। পরিচারিকারাও নৃত্যগীতের পরে পরিশ্রান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর রাতে কুমার জেগে উঠলেন। কোথাও পিনপতন শব্দ নেই। রাতের নীরবতা সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। নিদ্রামগ্ন নর্তকীদের পরিহিত এলোমেলো বস্ত্র, বীভৎস চেহারা এবং দেহের বিকৃত রূপ মুহূর্তের মধ্যে কুমারের হৃদয়কে সংসারের প্রতি আরও বীতস্পৃহ করে তুলল। সুরম্য রাজপ্রাসাদ তার কাছে মহাশ্মশান মনে হলো। সে রাতেই তিনি সংসার ত্যাগ করার দৃঢ় সংকল্প নিলেন। সেদিনই ছিল শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি। দেবরাজ ইন্দ্র সিদ্ধার্থের সংসার ত্যাগ আসন্ন এবং গভীর রাতেই গৃহত্যাগ করবেন বুঝতে পেরে বিশ্বকর্মাকে প্রেরণ করলেন। ছদ্মবেশী দেবপুত্র সিদ্ধার্থকে অপূর্ব রাজপোশাক ও রাজমুকুটে সুসজ্জিত করলেন। সিদ্ধার্থ এই দিব্য অলৌকিক শক্তিকে অনুমান করতে পারলেন। পরম হিতৈষী পিতা রাজা শুদ্ধোধন, মমতাময়ী মাতৃদেবী মহাপ্রজাপতি গৌতমী, প্রিয়তমা স্ত্রী যশোধরা, প্রাণপ্রতিম পুত্র রাহুল, রাজৈশ্বর্য এবং প্রিয় প্রজাদের ভালোবাসার বাঁধন ছিন্ন করে ঊনত্রিশ বছর বয়সে মুক্তিকামী সিদ্ধার্থ সত্যের সন্ধানে গৃহত্যাগ করলেন।

ধর্মচত্র প্রবর্তন

গৃহত্যাগের পর রাজ নন্দন সিদ্ধার্থ সাধনায় নিমগ্ন হলেন। শুরু হলো দুঃখ মুক্তির অদম্য প্রচেষ্ঠা। ছয় বছর কঠোর সাধনা বলে অবশেষে তিনি অবর্তীণ হলেন কঠিন যাত্রায়। খুঁজে পেলেন মুক্তির পথের ঠিকানা। মানুষ কেন জন্ম-মৃত্যুর কবলে পড়ে, কে কোথায় যায়, কোথা হতে আসে, ইত্যাদি রহস্যময়তার সমাধান পেলেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর প্রথমে তিনি চিন্তা করেছিলেন যে তিনি ধর্ম প্রচার করবেন না। কারণ সাধারণ তৃষ্ণাতুর মানুষেরা এই তৃষ্ণাক্ষয়ী নৈর্বাণিক ধর্ম বুঝবে না। কিন্তু দেব-ব্রক্ষার অনুরোধে স্বর্গ-মর্ত্য সবার কল্যাণে ধর্ম প্রচার করার চিন্তা মনে স্থান দিলেন। অবশেষে বুদ্ধ সারনাথে সর্বপ্রথম ধর্মচক্র প্রবর্ত্তন করলেন। এর প্রাচীন নাম ঋষিপতন মৃগদায়। ঋষিগণ গন্ধমাধব পর্বত থেকে আকাশ পথে এসে সেখানে অবতরণ করতেন। ঋষিদের পতন স্থান বলে সারনাথের অপর নাম ছিল ঋষিপতন। হত্যা করার জন্য আনীত মৃগদের সেখানে ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে ইহার আরেক নাম মৃগদায় অর্থাৎ মৃগবন। প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কীয় বিষয়ের জন্য সারনাথ সুপ্রসিদ্ধ। অশোক স্তূপের পূর্ব পাশে যে মন্দিরের চিহ্ন বিরাজমান সেটাই ধর্মচক্র প্রবর্ত্তন স্থান। প্রত্যেক সম্যক সম্বুদ্ধের এই স্থানই প্রথম ধর্ম প্রচার স্থান। এই স্থান অপরিবর্তনীয়। প্রথম ধর্মদেশনায় ১৮ কোটি দেব-ব্রহ্মা জ্ঞান লাভ করেছিলেন। মানুষের মধ্যে একজন মাত্র জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যার নাম কৌন্ডিন্য। সেদিন ছিল শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা। শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিনে বুদ্ধের জীবনে আরেকটি অলোকিক ঘটনা ঘটেছিল। সেই নান্দনিক ঘটনাটি হলো শ্রাবস্তীর গণ্ডাম্ব্র বৃক্ষমূলে বুদ্ধের ঋদ্ধি প্রদর্শন ও স্বর্গারোহন।

শ্রাবস্তীতে ঋদ্ধি প্রদর্শন

বুদ্ধের সময় আরো ছয়জন শাস্তা ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশে ছিলেন নগ্ন সন্ন্যাসী। এক এক জনের মতবাদ ছিল এক এক রকম। নিজেদের দৃষ্টিতে যা ভালো মনে হয়েছে তা ভক্তদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। মূলত তাঁরা কেউ সাধক কিংবা সত্য সন্ধ্যানী ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন তীর্থিক। তাঁদের একজন সঞ্জযো বেলটুঠপুত্তো নামক শাস্তা অতি ধুরন্ধর প্রকৃতির ছিলেন। তার বাদ ছিল অমরা বিক্ষেপ। কিছুতেই ধরা দিতেন না। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘আমি এইরূপও বলি না, সেইরূপও বলি না। অন্যথাও আমি বলি না, না বলিয়াও আমি বলি না। ’ এমন উত্তর দিয়ে বাক্য বিক্ষেপ বা অমরা বিক্ষেপ করতেন। এমন কৌশল গ্রহণ করার কারণ ছিল মিথ্যা ধরা পড়ার ভয়, যেহেতু কিছুই তিনি সঠিকভাবে জানতেন না। সেই সময়ের মহারাজ অজাতশত্রু তার উত্তর শুনে বলেছিলেন, ছয় শাস্তার মধ্যে এ ব্যক্তি সবচেয়ে অজ্ঞানী। গৌতম বুদ্ধের কারণে তাদের লাভ সৎকারে ভাটা পড়ছিল। তাই তারা বুদ্ধের বিরুদ্ধে বলতেন। বিভিন্ন মিথ্যা অপপ্রচার এবং রটনা রটাতেন। তারা বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধের চরিত্রে কলংক লেপনের চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু কখনো সফল হতে পারেননি। বুদ্ধ এবং বুদ্ধের জ্ঞান এবং শক্তি সম্পর্কে তারা সম্যক অবগত ছিলেন না। তাদের শিষ্যরা বলে বেড়াতেন, বুদ্ধ তাদের চেয়ে অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন নয়। অলৌকিক শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা হলে বুদ্ধ হেরে যাবেন। ইত্যাদি কথা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতেন। বুদ্ধের শিষ্য এবং অনুসারীরা বুদ্ধকে এসব কথা বলতেন। কিন্তু সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী বুদ্ধ এসব কথায় গুরুত্ব দিতেন না। পরে বুদ্ধ ভাবলেন এই অপপ্রচারে যদি মানুষের ভেতরে বুদ্ধের প্রতি কোনো সন্দেহ এবং অশ্রদ্ধা উৎপন্ন হয় কিংবা যারা অপপ্রচারে লিপ্ত আছেন তাদের পাপ হবে। এই সন্দেহ এবং দ্বন্দ্ব দূর করা প্রয়োজন। ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা সমাপ্ত হলে ষষ্ঠ বর্ষাযাপনের জন্যে ভগবান বুদ্ধ প্রয়াস করলেন রাজগৃহের অন্তঃপাতী মকুল পর্বতে। এই সময়ে রাজগৃহ শ্রেষ্ঠী জম্বুদ্বীপে প্রকৃত অর্হৎ আছেন কিনা পরীক্ষা করবার জন্যে একটি ৫০ হাত সুদীর্ঘ বংশদণ্ডের অগ্রভাগে একটি মহামূল্য চন্দন কাষ্ট নির্মিত পাত্র স্থাপন করে ঘোষণা করে দিলেন, ‘ঋদ্ধি বলে কেহ যদি শূন্যে উত্থিত হয়ে ওই পাত্রটি গ্রহণ করতে পারেন তবে উহা তাঁরই হবে। ’ আয়ুস্মান মহামৌদ্গল্যায়ন ও পিণ্ডোল ভরদ্বাজ রাজগৃহ নগরে ভিক্ষা চর্য্যায় বের হয়ে সন্ন্যাসীদের এই হঠকারিতা ও বিভ্রান্তি অবলোকন করেন। ভিক্ষা চর্যার পর মহামৌদ্গল্যায়ন নির্দেশক্রমে শ্রেষ্ঠী প্রদত্ত সেই চর্তুমধুর ভাণ্ডটি নেবার জন্য অভিজ্ঞাপাদক ধ্যান অনুশীলন করে বিরাট এক খণ্ড মেঘ সৃষ্টি করে, আকাশ পথে ভ্রমণ করছিলেন। জন সাধারণ স্থবিরের এই অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপ দর্শনে বিস্মিত হল এবং জনগণ বলতে শুরু করল যে, ভদন্ত পিণ্ডোল ভারদ্বাজ, আপনি আমাদের ত্রাণ করুন। স্থবির মহোদয় তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আকাশের মেঘ খণ্ড অপসারিত করে বংশাগ্রে স্থিত সেই চর্তুমধুর ভাণ্ডটি আপন হাতে নিয়ে ভূমিতে নেমে আসলেন এবং বেণুবন বিহারের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে দলে দলে লোক তাঁর পশ্চাৎ অনুগমন করল। তীর্থিকদের মধ্যে কেহই উহা গ্রহণ করতে সমর্থ হল না। আয়ুস্মান মৌদ্গল্যায়নের নির্দেশে ‘পিণ্ডোল ভারদ্বাজ’ নামক জনৈক ভিক্ষু ঋদ্ধি বলে পাত্রটি গ্রহণ করেন। ভগবান বুদ্ধ উহা জানতে পেরে ভিক্ষুদের পক্ষে কাষ্ঠনির্মিত পাত্রের ব্যবহার এবং ঋদ্ধি প্রদর্শন উভয়ই নিষিদ্ধ করে দেন। এতে তীর্থিকেরা বলে বেড়াতে লাগল যে শাক্যপুত্রীয় শ্রমণেরা ঋদ্ধি প্রদর্শন করলে আমাদের সাথে পেরে উঠবে না। তাই শাক্যপুত্র গৌতম তাঁর শিষ্যদের ঋদ্ধি প্রদর্শনে নিষেধ করেছেন। বুদ্ধ বললেন আমার শিষ্যরা ঋদ্ধি প্রদর্শনে নিষিদ্ধ হলেও প্রয়োজন বোধে আমি নিজে উহা প্রদর্শন করতে পারি।

স্থির হলো চার মাস পরে শ্রাবস্তীর গণ্ডাম্ব বৃক্ষ মূলে তিনি তাঁর ঋদ্ধি প্রদর্শনের এই প্রতিশ্রুত রক্ষা করবেন। তীর্থিকেরা এ সংবাদ পেয়ে নির্দিষ্ট স্থানের চতুর্দিকে এক যোজনের মধ্যে যত আম্রবৃক্ষ আছে সমস্ত উৎপাটিত করে ফেলল। নির্দিষ্ট দিনে যথা স্থানে উপস্থিত হয়ে ভগবান বুদ্ধও জনসংঘ দেখলেন। আশেপাশে আম্র বৃক্ষের চিহ্নও বিদ্যমান নেই। রাজ্যেদ্যানের মালী গ- কোথা থেকে একটি পক্ক আম্রসংগ্রহ করে এনে ভগবানকে উপহার দিলেন। তিনি তাকে উহা মাটিতে পুতিতে আদেশ দিলেন। অতঃপর ভগবান ব্দ্ধু উহার উপরে হাত ধুয়ে জল দেওয়া মাত্র ইহা ৫০ হস্ত দীর্ঘ এক মহীরুহে পরিণত হয়। তখন ভগবান বুদ্ধ ঋদ্ধি বলে শূণ্যের উপর এক মণিময় বিহার ভূমি রচনা করে। তদুপরি উঠে ‘যমক প্রতিহার্য প্রদর্শন করেন। প্রথমে ভগবান বুদ্ধ শূণ্যে উত্থিত হন তাঁর উর্দ্ধাঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা উত্থিত হয় ও নিম্নাঙ্গ থেকে বারিধারা বর্ষিত হতে থাকে। অতঃপর উর্দ্ধাঙ্গ থেকে বারিধারা ও নিম্নাঙ্গ থেকে অনলশিখা প্রবর্তিত হতে থাকে। তারপর পর্যায়ক্রমে ডানপার্শ্ব থেকে অগ্নি ও বাম পার্শ্ব থেকে জল, ডান পার্শ্ব থেকে জল বাম পার্শ্ব থেকে অগ্নি প্রবর্তিত হতে থাকে। এভাবে ক্রমান্বয়ে বাইশ প্রকার ঋদ্ধি প্রদর্শন সমাপ্ত হলে তিনি জনগণকে এমন ভাবে মোহাবিষ্ট করলেন যে তাদের মনে হল তিনি উক্ত মণিময় বিহার ভূমিতে দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে থেকে বিভিন্ন প্রকারের দৃষ্টি বিভ্রান্তি ঘটালেন। বিভিন্ন ধরণের হৃদয়ছোঁয়া ঘটনাবলির কারণে আষাঢ়ী পূর্ণিমা একটি অনন্য পূর্ণিমা তিথির নাম। বৌদ্ধদের জন্য আষাঢ়ী পূর্ণিমা পূণ্যের সুবাসী বারতা নিয়ে হাজির হয়। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই তিনমাস ভিক্ষুসংঘের পাশাপাশি বৌদ্ধ উপাসক-উপাসিকারাও বর্ষাবাস পালন করে থাকেন। এই সময়ে তারা প্রতি উপোসথ দিবসে অষ্টশীল গ্রহণ, দানকর্ম, ভাবনাকার্য সহ ইত্যাদি পূণ্যকর্মের মাধ্যমে বর্ষাবাস পালন করে থাকেন। এই সময়ে পূজনীয় ভিক্ষুসংঘরা তথ্য বহুল অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মদেশনা উপাসক উপাসিকাদের দান করেন। পাপকর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য সাধারণ গৃহিরা সাধ্যমত চেষ্ঠা করেন। প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকেন। এমনকি এই তিন মাসের মধ্যে সামাজিক অনুষ্ঠান বিয়ের অনুষ্ঠানও হয় না। ভিক্ষুসংঘরাও বর্ষাবাস চলাকালীন সময়ে কেউ বিহারের বাইরে থাকতে পারেন না। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে থাকার নিয়ম থাকলেও এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসতে হয়।




শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

পুজনীয় উ. সুমনশ্রী থেরো (অরণ্য ভান্তে) এর সংক্ষিপ্ত জীবন পঞ্জি

পুজনীয় উ. সুমনশ্রী থেরো (অরণ্য ভান্তে) এর সংক্ষিপ্ত জীবন পঞ্জি


জন্ম ও শৈশব কাল : - রাউজান উপজেলার বৌদ্ধ অধ্যুষিত গ্রাম বিনাজুরীতে সুনীল বড়ুয়ার ওরশজাত মায়া বড়ুয়ার কোল জুড়ে শুভ ক্ষনে শুভলগ্নে ধরাধামে আসে ২য় পুত্র সন্তান। সেদিন ছিল ১ জুন ১৯৮৪ সাল শুক্রবার। চারিদিকে খুশীর জোয়ার, বাড়ির বয়স্ক মাতৃমন্ডলী উলু ধ্বনী দিয়ে জয় জয় রব শোনালো সমস্বরে। বাবা-মা আদর করে জয় বলে ডাকতে শুরু করল। শুভদিন ঠিক করে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন উৎসব করে নাম রাখল সবুজ বড়ুয়া।

১৯৯১ সালে সুনীল বড়ুয়া জীবন জীবিকার তাগিদে পরিবার পরিজন নিয়ে আদি নিবাস বিনাজুরী ছেড়ে একেবারে চলে আসেন রাঙ্গুনিয়া শুকবিলাস গ্রামে। শুকবিলাসে তিনি বসতবাড়ি গড়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। সুনীল বড়ুয়ার দুই পুত্র সন্তানের মধ্যে সবুজ বড়ুয়া ছোট। তিনি দুইজনকে শুকবিলাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে জয় তথা সবুজ বড়ুয়া ১ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে। ১৯৯২ সালে চলে যায় বেতাগী অনাথ আশ্রমে। আশ্রমে থাকাকালীন সময়ে ভর্তি হন বেতাগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । এই বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে আশ্রম ছেড়ে চলে যায় পূর্ব আধাঁরমানিক শ্রদ্ধানন্দ বিহারে, ভর্তি হন আধাঁরমানিক নতুন বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে।

প্রবজ্যা : - সবুজ বড়ুয়া জয় এতোদিন পর্যন্ত অনুধাবন করল যে, সংসার দুঃখময় বর্জ্যে পরিপূর্ন। তাই বিবিধ সাংসারিক উপদ্রববিহীন অনাগরিক জীবন লাভের ব্রতী হয়ে বুদ্ধ শাসনে অনুপ্রবেশের জন্য দুঃখকে জয় করার প্রত্যয়ে ১৯৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার শুভদিনে ১২ বছর বয়সে প্রবজ্যিত হয়ে সুমনশ্রী শ্রমন নাম রাখা হল।

উপসম্পদা : - সুমনশ্রী শ্রামণ বুদ্ধের দর্শনকে পরিপূর্ণভাবে জানার মানসে শীল সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলনের জন্য ২৭ অক্টোবর ২০০৫ সালে এক মহালগ্নে উপসম্পদা লাভ করেন।

প্রাতিষ্টানিক শিক্ষালাভ : - শ্রমণ অবস্থায় আধাঁরমানিক নতুন বাজার উচ্চ বিদ্যালয় হতে এস এস সি এবং কুয়াইশ ডিগ্রী কলেজ থেকে ২০০৬ সালে মানবিক বিভাগ হতে এইচ এস সি কৃতিত্বের সহিত পাশ করেন।

বিদেশ ভ্রমণ :- বুদ্ধের ধর্ম ও বিনয় শিক্ষার জন্য ১১ বার ভারত, ২ বার শ্রীলংকা, ১ বার নেপাল, ২ বার বার্মা এবং ১ বার থাইল্যান্ড প্রভৃতি প্রতিরূপ দেশ ভ্রমণ করেন। বিমুক্তির পথ অন্বেষণে প্রথমবার শ্রীলংকা গুন আর্দানা বিদর্শন ভাবনা সেন্টারে দ্বিতীয়বার বার্মা আন্তর্জাতিক অর্হৎ মাহাসি নিগাহ্ সতিপট্ঠান ভাবনা কেন্দ্রে ধ্যান অনুশীলন করেন।

ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান : - বার্মা ধ্যান সেন্টারে ২০০৫ সালের জুলাই মাসে ত্রিচীবরিক, পিন্ডপাতিক, একাসনিক, কলুপৎসাত ও শয়নাসন ইত্যাদি বিষয়ে অধিষ্ঠান রত ছিলেন এবং ওখানে কিছুদিন অবস্থান করেন।

শশ্মানিক অধিষ্ঠান : - দীর্ঘদিন বার্মা ধ্যান সমাধি অনুশীলন করে চরণদ্বীপ জ্ঞানাঙ্কুর বিহারে ফিরে আসেন। চরণদ্বীপ জ্ঞানাঙ্কুর বিহারে অবস্থানকালিন সময়ে ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর আশ্বিনী পূর্ণিমা তিথিতে রাত ১২ টা হইতে কাকডাকা ভোর পর্যন্ত নিরবে নিভৃতে চরণদ্বীপ একটি পারিবারিক শশ্মান ভূমিতে অধিষ্ঠান শুরু করেন। একদিন চরণদ্বীপ গ্রামবাসীর কাছে ভান্তের অধিষ্ঠান প্রকাশ পায়। এরপর থেকে পরিপূর্নভাবে ৬ মাস এই শশ্মানে অবস্থান করেন।

বৌদ্ধ শশ্মান পরিভ্রমণ : - চরণদ্বীপ শশ্মান ভূমি হতে বের হয়ে ২০১৬ সালের ৬ মে বিভিন্ন গ্রামের শশ্মানে বুদ্ধ নির্দেশিত ” বহু জনের হিতের জন্য বহু জনের সুখের জন্য চারিদিক বিচরণ করো ” - এই ব্রত নিয়ে ২০টির অধিক গ্রামে পিন্ডচারণ ও ধর্মদেশনা শুরু করেন। যেমন বোয়ালখালী উপজেলার গোমদন্ডী, চান্দগাঁও, কধুরখীল, শাকপুরা লালার পাড়া, বৈদ্যপাড়া, করলডেঙ্গা, শ্রীপুর, খরণদ্বীপ, জ্যৈষ্ঠপুরা, পটিয়া উপজেলার পাঁচরিয়া, চরকানাই, লাখেরা, পিঙ্গলা, ভান্ডারগাঁও, কর্তালা, তেকোটা, রাউজান উপজেলার পাঁচখাইন, বাগোয়ান, পাহাড়তলী, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেতাগী ধারাবাহিকভাবে অবস্থান করেন।

আরণ্যিক অধিষ্ঠান : - বোয়ালখালী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও পটিয়া উপজেলার ২০টির অধিক বৌদ্ধ শশ্মানে অধিষ্ঠান করে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই হতে শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের জ্যৈষ্ঠপুরার গহীন অরণ্যে অদ্যাবধি অধিষ্ঠান রত আছেন। শীল সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলন করে সর্বোপরি নির্বাণ সাধনায় রত থেকে আজীবন অরণ্যে অবস্থান করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহন করেন।


মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২১

বুদ্ধের ভিক্ষুসংঘকে মঙ্গলবিষয়ক সাতটি উপদেশ

বুদ্ধের ভিক্ষুসংঘকে মঙ্গলবিষয়ক সাতটি উপদেশ

 


হে ভিক্ষুগণ, আমি তোমাদের সাতটি মঙ্গলবিধায়ক ধর্মের উপদেশ দেবো, শোনো, উত্তমভাবে মনঃসংযোগ করো।’

১ ৷ হে ভিক্ষুগণ, যতদিন ভিক্ষুগণ নিজেদের সম্মিলনের ব্যবস্থা করে বার বার একত্রিত হবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷
২৷ যতদিন তাঁরা সমগ্র হয়ে একত্রিত হবেন ৷ সমগ্র হয়ে উত্থান করবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

৩৷ যতদিন সমগ্র হয়ে সংঘনির্দিষ্ট কর্মসমূহের সম্পাদন করবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

৪ ৷ যতদিন তাঁরা অব্যবস্থিতের ঘোষণা না করবেন, ব্যবস্থিতের উচ্ছেদ না করবেন, যথাব্যবস্থিত শিক্ষাপদগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

৫ ৷যতদিন তাঁরা তাঁদের মাঝে যাঁরা অভিজ্ঞ, বহুপূর্বগ, সংঘপিতা, সংঘপরিনায়ক, তাঁদের সৎকার করবেন, তাঁদের ভক্তি করবেন, তাঁদের সম্মান ও পূজা করবেন, তাঁদের বাক্য উপদেশ মেনে চলা উচিত বলে মনে করবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷


৬ ৷ যতদিন তাঁরা উৎপন্ন পুনর্জন্মদায়ক তৃষ্ণার বশবর্তী না হয়ে তাঁরা নির্জনবাসে প্রীতিলাভ করবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

৭ ৷ যতদিন তাঁরা নিজ নিজ চিত্তের সৈ'র্য সম্পাদন করবেন, যাতে অনাগত প্রিয়শীল সব্রহ্মচারীগণ তাঁদের কাছে আসতে পারেন এবং যাঁরা আগত তাঁরা স্বচ্ছন্দে অবস্থান করতে পারেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

যতদিন এই সাত মঙ্গলবিধায়ক ধর্ম তাঁদের মাঝে বর্তমান থাকবে, যতদিন তাঁরা ওই ধর্মানুসারে নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করবেন, ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

[©ফেইসবুক থেকে নেওয়া]

শনিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০২১

মহামানব গৌতম বুদ্ধ (পর্ব২)দীপংকর বুদ্ধের সাক্ষাৎ

মহামানব গৌতম বুদ্ধ (পর্ব২)দীপংকর বুদ্ধের সাক্ষাৎ

 



এভাবে সুমেধ তাপস অভিজ্ঞাশক্তি অর্জন করে হিমালয়ে সমাপত্তিসুখে অবস্থানকালে জগতে দীপংকর নামে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর মায়ের গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ, জন্ম, সম্বোধিলাভ ও ধর্মচক্র প্রবর্তনের সময় দশ হাজার চক্রবাল কম্পিত, প্রকম্পিত ও আন্দোলিত হয়ে মহাশব্দে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এবং বত্রিশ প্রকার পূর্বনিমিত্ত দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সুমেধ তাপস গভীর সমাপত্তিধ্যানে মগ্ন থাকায় সেই মহাশব্দ শোনেননি, আর সেসব নিমিত্তও (লক্ষণ) দেখেননি।

সে সময় দীপংকর বুদ্ধ চার লক্ষ আস্রবহীন শিষ্যসহ বিচরণ করতে করতে ‘রম্যক’ নামক নগরের উপকণ্ঠে সুদর্শন মহাবিহারে অবস্থান করছিলেন। রম্যনগরবাসীগণ শুনল যে, শ্রমণশ্রেষ্ঠ দীপংকর পরম সম্বোধি লাভ করে ধর্মচক্র প্রবর্তনের পর ক্রমান্বয়ে ভ্রমণ করতে করতে তাদেরই নগরের কাছে সুদর্শন মহাবিহারে বাস করছেন। এই খবর শুনে তারা তখন ঘি, মাখনাদি ওষুধ এবং সুন্দর আচ্ছাদন, সুগন্ধি দ্রব্য, ফুল-বাতি ইত্যাদি যাবতীয় পূজার সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে প্রগাঢ় শ্রদ্ধাসহকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘমনা হয়ে বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হলো এবং বন্দনা ও পূজার সামগ্রীগুলো নিয়ে পূজা করে সবাই একপাশে বসল। বুদ্ধ তাদের ধর্মোপদেশ দানে তৃপ্ত করলে সবাই আসন হতে উঠে বুদ্ধকে আগামী পরদিনের জন্য নিমন্ত্রণ করে নিজ গ্রামে চলে গেল।

পরদিন সেখানকার সব নাগরিক এক মহাদানযজ্ঞের আয়োজন করে নগরীকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে তথাগতের আগমন-পথ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করল। বর্ষাকালীন জলস্রোতে রাস্তার ভাঙা অংশ এবং অসমতল কিংবা কাদাময় স্থানগুলো নতুন মাটি দিয়ে সমতল করে তাতে সাদা রঙের বালু ছিটাতে লাগল। তার ওপর লাজ-ফুল ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন কাপড়ের ধ্বজাপতাকা উত্তোলন করল। এ ছাড়াও স্থানে স্থানে কলাগাছ রোপণ ও মঙ্গলঘট স্থাপন করল। সে সময় সুমেধ তাপস আশ্রম হতে বের হয়ে আকাশপথে যাবার সময় নিচে কর্মব্যস্ত উল্লসিত জনতাকে দেখে শিগগিরই আকাশ হতে অবতরণ করে জনগণকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘বন্ধুগণ, কোন ভাগ্যবান পুরুষের আগমন উপলক্ষে তোমাদের এই বিরাট আয়োজন?’

প্রত্যুত্তরে লোকজন তাঁকে বলল, ‘প্রভু সুমেধ, আপনি কি জানেন না যে দীপংকর বুদ্ধ সম্যক সম্বোধি লাভ করে ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছেন? সম্প্রতি তিনি দেশ পর্যটন করতে করতে আমাদের নগরসীমায় সুদর্শন মহাবিহারে বাস করছেন। আজ আমরা তাঁকে নিমন্ত্রণ করেছি। তাঁর আগমন উপলক্ষেই রাস্তাঘাট সংস্কার ও সাজানো হচ্ছে।’ এই কথা শুনে তাপস ভাবলেন, “বুদ্ধ উৎপন্নের কথা দূরে থাকুক, ‘বুদ্ধ’ এই শব্দ শোনাও জগতে অতি দুর্লভ। সুতরাং এই জনগণের সঙ্গে সংস্কারকাজে আমারও অংশগ্রহণ করা অবশ্যকর্তব্য।” এই চিন্তা করে তিনি জনগণকে অনুরোধ করে বললেন, ‘মহাশয়গণ, আপনারা যদি সম্যকসম্বুদ্ধের আগমন উপলক্ষেই এই সংস্কারকাজে আত্মনিয়োগ করে থাকেন, তা হলে অনুগ্রহ করে আমাকেও সেই পুণ্যের একজন অংশীদার করুন। আপনাদের সঙ্গে আমিও এই সংস্কারকাজে আত্মনিয়োগ করব।’

তারা আনন্দসহকারে সেই প্রস্তাবে সম্মত হলো। তারা জানত যে, এই সুমেধ তাপস হচ্ছেন মহা অলৌকিক শক্তিধর। তাই তারা তাঁকে এক কাদাযুক্ত স্থান দেখিয়ে বলল, ‘ভন্তে, আপনি এখানটি সমতল করে সুন্দরভাবে সাজান।’ সুমেধ তাপস ‘বুদ্ধ’ ‘বুদ্ধ’ বলে বুদ্ধকে উপলক্ষ করে প্রীতি উৎপন্ন করে ভাবলেন, আমি ইচ্ছা করলে রাস্তার এই ভাঙা-অংশটুকু আমার অলৌকিক শক্তিবলে অল্প সময়ে অনায়াসে সংস্কার করতে পারি। কিন্তু তাতে আমি তৃপ্ত হব না। বরং আজ আমি কায়িক শ্রমের দ্বারা কাজটি সম্পন্ন করে বুদ্ধের সেবা করব। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি নিজ হাতে মাটি আহরণ করে সেই অংশটি সংস্কার করতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর কাজ শেষ হবার আগেই মারজিৎ দীপংকর মহামুনি ষড়ভিজ্ঞ, সমদর্শী এবং বিগতমল চার লক্ষ ক্ষীণাস্রব শিষ্যসহকারে রাস্তায় পৌঁছে গেলেন। দেবমনুষ্যগণ আমোদিত হয়ে তাঁকে আগু বাড়িয়ে নিল এবং নানাপ্রকার ভেরিনিনাদে গগনমণ্ডল মুখরিত করে সাধুবাদ দিতে লাগল।

তখন দেবতারা মানুষদের আর মানুষেরা দেবতাদের দেখতে পাচ্ছিল। তারা উভয় পক্ষই করজোড়ে তথাগত বুদ্ধের অনুগমন করছিল। দেবগণ দিব্য তূর্যধ্বনি আর মানুষেরা মানুষিক তূর্যধ্বনি করতে করতে মহামুনি দীপংকর বুদ্ধের অনুগমন করছিল। দেবতারা আকাশ থেকে দিব্য মন্দার ফুল, পদ্ম ফুল ও পারিজাত ফুল চারদিকে ছিটিয়ে দিচ্ছিল। মানুষেরা পৃথিবী থেকে চম্পক, কুসুম, কদম, নাগেশ্বর, পুন্নাগ, কেতকী ও পদ্ম শাপলা ইত্যাদি ফুল ওপরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছিল।

এমতাবস্থায় সুমেধ তাপস অনন্যোপায় হয়ে নিজের হিত চিন্তা করে মনে মনে বললেন, ‘বুদ্ধের জন্য প্রয়োজনে আমি নিজের জীবনও বিলিয়ে দিতে পারি। তাই তিনি যাতে কাদায় না পড়েন, সেই ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে। আমি কাদায় শুয়ে পড়ব, আর চার লক্ষ আস্রবহীন অর্হৎসহ বুদ্ধ আমার পিঠের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবেন। এতে করে আমার ভাবী মঙ্গল হবে।’ এই ভেবে তিনি তাতে সেতুর মতো করে শুয়ে পড়লেন।

তিনি শায়িত অবস্থায় বুদ্ধের অপূর্ব বুদ্ধশ্রী অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে ভাবতে লাগলেন, ‘এখন আমি ইচ্ছা করলেই সব ক্লেশগুলো ধ্বংস করে সংঘভুক্ত হয়ে এদের সঙ্গেই রম্যনগরে প্রবেশ করতে পারি। কিন্তু জনসাধারণের অজ্ঞাতসারে চার আর্যসত্য ধর্মকে প্রত্যক্ষ করে আমি তৃপ্তি লাভ করতে পারব না। বরং আমি দীপংকর বুদ্ধের মতো সর্বজ্ঞতা লাভ করে অসংখ্য দেবমানবকে ধর্মনৌকায় তুলে নিয়ে ভবদুঃখ থেকে ত্রাণ করব। পুরুষোত্তম দীপংকর বুদ্ধের কাছে কৃত আমার এই শ্রেষ্ঠ কর্মের বিপাকে সর্বজ্ঞতা লাভ করে অসংখ্য প্রাণীকে মুক্ত করব। সংসারস্রোত ছিন্ন করে এবং কাম, রূপ ও অরূপ, এই ত্রিভবের কর্মক্লেশ ধ্বংস করে আর্য-অষ্টাঙ্গিক-মার্গরূপ ধর্মনৌকায় তুলে দেবমনুষ্যগণকে মুক্ত করব।’—অপদান অর্থকথা

বুধবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২১

গৌতম বুদ্ধের অতীত জন্ম(সুমেধ তাপস)

গৌতম বুদ্ধের অতীত জন্ম(সুমেধ তাপস)

আজ হতে লক্ষাধিক চার অসংখ্য কল্পেরও আগের কথা। তখন অমরাবতী নামে এক দর্শনীয় মনোরম নগরী ছিল। সেই সৌভাগ্যবতী নগরী সর্বদা হাতির বৃংহতি ধ্বনিতে, ঘোড়ার হ্রেষা রবে, গাড়ির ঘর্ঘর শব্দে, ভেরীর লহরি ছন্দে, মৃদঙ্গের সুমধুর তালে এবং বীণা ও গানের মধুর সুরে ঝংকৃত হতো। এ ছাড়াও পরমাদরে বন্ধুসম্ভাষণে, বায়ু সঞ্চালিত তালপাতার মর্মর ধ্বনিতে এবং ‘স্নান করো’ ‘পান করো’ ও ‘ভোজন করো’—এই দশটি সুমিষ্ট শব্দের দ্বারা সব সময় মুখরিত থাকত। সেটি ছিল সব দিক দিয়ে সুশোভিত সপ্ত রত্নসম্পন্ন এবং জনাকীর্ণ এক সমৃদ্ধ নগরী, যেন মনে হতো কোনো দেবনগরী। সেখানে সুমেধ নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন যিনি ছিলেন বহু কোটি ধনে ধনী, অঢেল ধনধান্যসম্পন্ন, অধ্যাপক, মন্ত্রধারী, ঋক-সাম-যজুঃ—এই ত্রিবেদে পারদর্শী এবং লক্ষণশাস্ত্র, ইতিহাস ও স্বকীয় ধর্মে অতুলনীয় পণ্ডিত। মাতাপিতা উভয় কুলের সাত পূর্বপুরুষ পর্যন্ত জাতিতে তিনি সুপরিশুদ্ধ ছিলেন। বংশমর্যাদায় তিনি ছিলেন অনিন্দনীয় এবং অসাধারণ ছিল তাঁর রূপলাবণ্য। তিনি অন্য কোনো প্রকার শিল্পবিদ্যা শিক্ষা না করে ব্রাহ্মণবিদ্যাই শিক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তিনি শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন হয়ে পড়লেন। এরপর একদিন তাঁদের ধনরক্ষক মন্ত্রী-লিখিত লোহার পাত এনে মণিমুক্তা ও সোনারুপায় পরিপূর্ণ সিন্দুকের দরজা খুলে বালক সুমেধকে বললেন, ‘কুমার, এই ধনসম্পত্তি তোমার মাতৃকুল হতে প্রাপ্ত, এগুলো পিতৃকুলের, আর এগুলো হচ্ছে তোমার বাপ-দাদা থেকে শুরু করে সাত পুরুষের সঞ্চিত ধনসম্পদ; তুমি এই ধন সযত্নে রক্ষা করো এবং ইচ্ছানুরূপ পরিভোগ করো।’ তা শুনে ব্রাহ্মণপুত্র সুমেধ ভাবলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষগণ পরলোকে যাবার সময় এই সঞ্চিত ধনসম্পত্তির এক টাকাও সঙ্গে নিতে পারেননি। আমি যেন এগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি, আমাকে তার উপায় বের করতে হবে।’—অপদান অর্থকথা এরপর তিনি একসময় নির্জনে বসে বসে চিন্তা করলেন, ‘পুনরুৎপত্তি ও মরণ দুঃখজনক।’ যেহেতু তিনি জন্ম-জরা ও ব্যাধি ধর্মের (স্বভাবের) অধীন, তাই তিনি সংকল্প করলেন, ‘আমি জরা-মরণবিহীন নিরাপদ স্থান নির্বাণের অন্বেষণ করব।’ মলমূত্র ও অন্যান্য বহু অশুচিতে পরিপূর্ণ এই দুর্গন্ধময় শরীরের প্রতি অনাকাঙ্ক্ষী হয়ে, নিরালয় হয়ে তা ত্যাগ করে নির্বাণে চলে যাই না কেন? যে পথ ধরে নির্বাণ লাভ হবে, সেটা নিশ্চয়ই আছে এবং থাকবে। এমন একটা পথ না থেকে পারে না। আমি সংসার হতে মুক্তির জন্য সে পথের অনুসন্ধান করব। যেমন শারীরিক-মানসিক দুঃখ বর্তমান আছে বলে সুখও বর্তমান আছে, সেরূপ ভব বিদ্যমানে ভবমুক্তিও বিদ্যমান আছে বলে আশা করা উচিত। উষ্ণতা বিদ্যমান থাকলে যেমন তার বিপরীতে শীতলতাও বিদ্যমান থাকে, তেমনই রাগ-দ্বেষ-মোহ—এই ত্রিবিধ অগ্নির বিদ্যমানে এদের নির্বাণও আকাঙ্ক্ষা করা উচিত। পাপ বিদ্যমান থাকলে যেমন পুণ্যও বিদ্যমান থাকে, তদ্রূপ জন্মগ্রহণ থাকলে জন্মের হেতু বিনাশেরও কামনা করা উচিত। মলমূত্রে লিপ্ত পুরুষ জলপূর্ণ পুকুর বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যদি পুকুরের খোঁজ না করে, তাতে যেমন পুকুরের দোষ হয় না, তেমনই ক্লেশমল ধোয়ার উপযোগী অমৃত পুকুর বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তার সন্ধান না করলে সেটা অমৃত পুকুরের দোষ হতে পারে না। চারদিকে শত্রুপরিবেষ্টিত অবস্থায় পালানোর পথ থাকলেও কোনো ব্যক্তি যদি পালিয়ে না যায় তা যেমন পথের দোষ নয়, তেমনই ক্লেশ দ্বারা অবরুদ্ধ ব্যক্তি যদি নির্বাণের পথ বিদ্যমান থাকতেও তার অনুসন্ধান না করে, সেটাও নির্বাণপথের দোষ নয়। কোনো ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি যদি চিকিৎসক বিদ্যমান থাকতেও তার ব্যাধির চিকিৎসা না করায়, তা যেমন চিকিৎসকের দোষ নয়, তেমনই ক্লেশব্যাধির দ্বারা দুঃখিত পীড়িত ব্যক্তি যদি নির্বাণপথের নির্দেশকারী আচার্যের অন্বেষণ না করে, তা হলে সেটাও নির্বাণপথের নির্দেশক আচার্যের দোষ নয়। কোনো সুখী ও স্বাধীন পুরুষের গলায় সাপ-কুকুর ইত্যাদির মৃতদেহ বেঁধে দিলে, সে যেমন তা ঘৃণার সঙ্গে ত্যাগ করে চলে যায়, তেমনই আমিও বহু পচাগলা জিনিসের আধার এই দুর্গন্ধময় শরীরের প্রতি নিরপেক্ষ ও অনাকাঙ্ক্ষী হয়ে তা ত্যাগ করে চলে যাব। ময়লা স্থানে স্ত্রী-পুরুষেরা যেমন মলত্যাগ করে অনাকাঙ্ক্ষী ও অপ্রত্যাশী হয়ে চলে যায়, সেরূপ আমিও নানা অশুচিপূর্ণ এই ভৌতিক দেহকে পায়খানাঘরে পায়খানা করে যাওয়ার মতো ত্যাগ করে চলে যাব। নৌকার মালিকগণ যেমন জীর্ণ, ছিন্নভিন্ন ও পানি ওঠে এমন নৌকার প্রতি নিরপেক্ষ ও অনাকাঙ্ক্ষী হয়ে সেটাকে ফেলে চলে যায়, সেরূপ আমিও চোখ-কান প্রভৃতি নয়টি ছিদ্রযুক্ত নিত্য গলিত অশুচিপূর্ণ এই পচা দেহকে জীর্ণ নৌকার মালিকের মতো ত্যাগ করে চলে যাব। কোনো ব্যক্তি যদি সোনারুপার জিনিস সঙ্গে নিয়ে চোর-ডাকাতদের সঙ্গে যাবার সময় সেই জিনিসগুলো কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখলে সেগুলো পরিত্যাগ করে চলে যায়, তেমনই এই দেহও হচ্ছে মহাচোরের মতো। তাই কুশলকর্মের ব্যাঘাতের ভয়ে আমিও এই চোরের মতো শরীর ত্যাগ করে চলে যাব।—বুদ্ধবংশ এভাবে তিনি বহু কারণ চিন্তা করে, বহু শতকোটি ধন ধনী-গরিবদের দান দিয়ে হিমালয় পর্বতে চলে গেলেন। হিমালয় পর্বতের কিছু দূরে ধম্মক নামে একটি পর্বত ছিল। সেখানে তাঁর আশ্রম ও পর্ণশালা সুন্দরভাবে নির্মিত হয়েছিল। দেবরাজ ইন্দ্র সেই আশ্রমের মধ্যে পাঁচটি দোষমুক্ত চংক্রমণপথ বা পায়চারির পথ নির্মাণ করিয়েছিলেন। সুমেধ তাপস সেখানে নয় প্রকার দোষযুক্ত বস্ত্র ত্যাগ করে বারো প্রকার গুণযুক্ত চীবর পরেছিলেন। আটটি দোষযুক্ত পর্ণশালা পরিত্যাগ করে দশ প্রকার গুণসম্পন্ন গাছের নিচে অবস্থান করেছিলেন। বপিত ও রোপিত ধানের অন্ন একদম ত্যাগ করে অনেক প্রকার গুণযুক্ত ঝরে পড়া ফলমূল খেয়েছিলেন। সেই আশ্রমে বসে, দাঁড়িয়ে ও চংক্রমণ করতে করতে তিনি উৎসাহসহকারে ধ্যান করে সপ্তাহের মধ্যেই পঞ্চ অভিজ্ঞাবল ও অষ্ট সমাপত্তি লাভ করেছিলেন।—অপদান অর্থকথা