Other লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
Other লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫

বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান: ধর্ম প্রচার ও জ্ঞানের আলোকবর্তিকা

বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান: ধর্ম প্রচার ও জ্ঞানের আলোকবর্তিকা

অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮২–১০৫৪ খ্রিঃ) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত, আচার্য এবং ধর্মপ্রচারক, যিনি পাল সাম্রাজ্যের শাসনামলে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।


জন্ম ও শৈশব

অতীশ দীপঙ্করের জন্ম ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে। তাঁর পিতা ছিলেন রাজা কল্যাণশ্রী এবং মাতা প্রভাবতী। জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয় চন্দ্রগর্ভ।

শিক্ষা ও দীক্ষামাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি নালন্দা মহাবিহারে অধ্যয়ন শুরু করেন এবং আচার্য বোধিভদ্রের নিকট শ্রমণ দীক্ষা গ্রহণ করেন, তখন তাঁর নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। পরবর্তীতে তিনি বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী এবং অন্যান্য বিখ্যাত বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রে অধ্যয়ন করেন। তিনি তন্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করেন।

ধর্মপ্রচার ও তিব্বত যাত্রা

তিব্বতের রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস’-ওদ অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে আমন্ত্রণ জানান। প্রথমে তিনি এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন, কিন্তু পরবর্তীতে রাজা বন্দী হলে এবং তাঁর পুত্র ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে আনতে উদ্যোগী হন। ১০৪০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তিব্বতের থোলিং বিহারে পৌঁছান এবং সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।


সাহিত্যকর্ম ও দর্শন

অতীশ দীপঙ্কর বহু গ্রন্থ রচনা করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'বোধিপথপ্রদীপ'। এই গ্রন্থে তিনি বোধিসত্ত্বের পথ এবং মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের মৌলিক দিকগুলো ব্যাখ্যা করেন।


মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

তিব্বতে ১৭ বছর ধর্মপ্রচারের পর ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিঃশেষ হন। তাঁর প্রধান শিষ্য ব্রোম-স্তোন-পা-র্গ্যল-বা'ই-'ব্যুং-গ্নাস কাদম্পা সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে গেলুকপা সম্প্রদায়ের ভিত্তি হয়।


সম্মান ও প্রভাব

২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিদের তালিকায় তিনি ১৮ নম্বরে স্থান লাভ করেন। [5] তিব্বতে তাঁকে 'জোবো ছেনপো' বা 'মহাপ্রভু' উপাধিতে অভিহিত করা হয়। [3]


📌অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছিলেন এক অনন্য বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত, যিনি জ্ঞান, নৈতিকতা ও মানবতাকে একসূত্রে বেঁধেছিলেন। তাঁর জীবন ও কর্ম আজও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।


শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

বিহারের রাজ্যপাল আরিফ মোহাম্মদ খানের অবিলম্বে পদত্যাগ দাবি

বিহারের রাজ্যপাল আরিফ মোহাম্মদ খানের অবিলম্বে পদত্যাগ দাবি

বুদ্ধ পূর্ণিমা আর বিহার রাজ্যের গভর্নর আরিফ মোহাম্মদ খান বোধগয়া মন্দিরে অনুষ্ঠানের সময় তথাগত বুদ্ধকে স্মরণ করেননি, বরং অন্যান্য দেব-দেবীর ধ্যান করেছেন, যা বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধ উপাসকদের মনে গভীরভাবে আঘাত করেছে। এর তীব্র নিন্দা করা হয়েছিল। উপরোক্ত মতামত প্রকাশ করেছেন পাঞ্জাব বৌদ্ধ সোসাইটি পাঞ্জাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট হরভজন সাম্পলা। অ্যাডভোকেট সাম্পলা বলেন, রাজ্যপাল হলেন দেশের ধর্মনিরপেক্ষ নেতা। কিন্তু তাদের এই আচরণ নিন্দনীয়। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে এ নিয়ে প্রচুর ক্ষোভ রয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, এই কালো কাজের জন্য তিনি রাজ্যপালের পদত্যাগ দাবি করেছেন। 


বুদ্ধ পূর্ণিমার শুভ উপলক্ষগুলি আর তথাগত বুদ্ধকে উপেক্ষা করা একটি ইচ্ছাকৃত ষড়যন্ত্র। বোধগয়া মুক্তি আন্দোলনের প্রতিবাদ সাইট বুদ্ধ পূর্ণিমায় এবং শ্রী লামা জির আবেদন আর ৩ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়েছিল। ভিক্ষু সংঘ, ভিক্ষু প্রজ্ঞা বোধি, ডঃ হরবনস বির্দি (পাঞ্জাব) এবং অল ইন্ডিয়া বৌদ্ধ সমাজের সাধারণ সম্পাদক আকাশ লামা এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন যে রাজ্যপালের অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত, কারণ তিনি তথাগত বুদ্ধকে সম্মান করেননি, বরং তাঁর মূর্তির দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তারা অন্যান্য দেব-দেবীর পূজা অব্যাহত রেখেছিল। বৌদ্ধ সম্প্রদায় ৫ জুন দিল্লির যন্তর মন্তর এবং রাজ্যপালের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করবে এবং তার পদত্যাগ দাবি করবে।




মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০২৩

শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমার তাৎপর্য

শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমার তাৎপর্য

 

শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমার তাৎপর্য


প্রতিসন্ধি গ্রহণ

বারাণসীর প্রায় পঞ্চাশ ক্রোশ উত্তরে নেপাল প্রদেশে রোহনী নদীর তীরে অবস্থিত কপিলাবস্তু নগরী। সেখানে রাজত্ব করতেন শাক্য বংশীয় রাজারা।মূলত শাক্য বংশীয়রা ইক্ষাকু বংশের বংশধর। ইক্ষাকুবংশীয় অম্ব নামে এক রাজার চারপুত্র ও চার রাজকন্যা রাজ্য থেকে নির্বাসিত হয়ে কপিলাবস্তুতে বাস করতেন।

রাজপুত্র ও রাজকন্যারা পরবর্তীতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী রূপে জীবনযাপন করতেন।

একসময় তাঁদের বংশবিস্তার হলো। তাঁদের বংশধরেরাই পরবর্তী সময়ের শাক্যবংশ, তাই কপিলাবস্তুর শাক্যেরা ইক্ষাকুবংশীয় বলে পরিচয় দেন।

শাক্য বংশের পূর্বসূরী রাজা জয়সেনের ছিল এক পুত্র সিংহহনু এবং এক কন্যা যশোধরা। সিংহহনুর চার পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। শুদ্ধোদন, অমৃতোদন, ধৌতধন, শুক্লোদন। দুই কন্যা যথাক্রমে অমিতা ও প্রমিতা। রোহনী নদীর অপর পরবর্তী দেবদেহ নামে স্থানে রাজা অনুশাক্যের কন্যা ইন্দ্রাণীর মতো রূপবর্তী মহামায়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ধার্মিক ও পুণ্যবান রাজা শুদ্ধোদন। দীর্ঘ সাংসারিক জীবনে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ না করায় রাজপ্রসাদের সুখ আর আনন্দ তাঁদের স্পর্শ করতে পারত না। সন্তানের মুখে মা ডাক শুনার জন্য মায়ের ব্যাকুলতা আর বংশের হাল ধরে রাখার জন্য পিতার উৎকণ্ঠা সর্বদা রাজপ্রসাদে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু উপায় কি। কর্মের বিধান পাল্টায় কে ! রাজা রাজশক্তি প্রয়োগ করে রাজ্যশাসন কিংবা রাজ্যদখল করতে পারেন। কিন্তু পিতার আসন লাভ করা তার চেয়েও দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। রাজা-রানীর মনে হতাশার অন্ত ছিল না।

এদিকে পৃথিবীতে অনাচার ছড়িয়ে পড়ল। দানবের প্রচণ্ড থাবায় মানবতা যেন বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। কে জাগাবে তাকে। বিপন্ন মানবতা। মানবপুত্র গৌতম বুদ্ধ তখন ৫৭ কোটি ৬০ লক্ষ বৎসর ব্যাপী তুষিত স্বর্গে বাস করছিলেন। মানবতার এই নাজুক অবস্থা দেখে দেবকুল শংকিত হয়ে পড়লেন। ত্রিশ প্রকার পারমী পরিপূর্ণ জগতের ভাবী সম্যক সম্বুদ্ধের নিকট দেবগণের আকুল প্রার্থনা ‘হে দেবাতিদেব, পৃথিবী আজ অনাচারে পরিপূর্ণ, চারদিকে ত্রাহি ত্রাহি রব, মানুষ আজ পথভ্রষ্ট, দিন দিন মার শাসন আর মারের উৎপাত প্রকট হয়ে উঠছে, দানবের শ্বাসরুদ্ধকর ঘরে মানবতা আজ অবরুদ্ধ, বিপন্ন মানবতা আর মুমূর্ষ ধরা বাঁচাতে ত্রিলোকের কল্যাণে আপনি মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করুন। ’ ভাবীবুদ্ধ তাদের প্রার্থনা স্বীকার করলেন। কথা দিলেন, ‘আমি কপিলাবস্তুর ধার্মিক রাজা শুদ্ধোধনের ঔরষে এবং পূণ্যবতী রানী মহামায়ার গর্ভে জন্মধারণ করে ত্রিলোককে মুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত করব। ’ সময় হতাশাগ্রস্ত রাজ-রানীকে আরো ব্যাকুল করে তুলল। কিন্তু না, এবার রানী মহামায়ার এক বিচিত্র স্বপ্ন দর্শন সমস্ত হতাশাকে বিদূরিত করে কপিলাবস্তুর কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলেন স্বপ্নপুরীতে। চারদিকপাল দেবতা পালঙ্কসহ তাঁকে তুলে নিয়ে গেলেন অনবতপ্ত হ্রদের তীরে। দেবতারা তাঁকে সপ্তযোজন উচুঁ সমতল ভূমির উপরে এক মহাশাল বৃক্ষের নিচে রেখে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। দেবপত্নীরা এসে রানীকে উক্ত হ্রদে ম্লান করিয়ে স্বর্গীয় ভূষণে অলংকৃত করলেন। চারদিক পাল দেবতারা রানীকে সুবর্ণময় প্রাসাদের দিব্যশয্যায় শয়ন করালেন। তারপর এক দিব্যকান্তি মহাপুরুষ শ্বেতহস্তীর রূপ ধারণ করে স্বর্ণময় পর্বত থেকে শুড়ে একটি শ্বেতপদ্ম নিয়ে অবতরণ করলেন। স্বেতহস্তীটি রানীর শয্যা তিনবার প্রদক্ষিণ করে তাঁর দক্ষিণপার্শ্ব ভেদ করে মাতৃজঠরে প্রবেশ করলেন। রাতের সেই অভিনব স্বপ্ন দর্শনের কথা তিনি মহারাজ শুদ্ধোধনকে জানালেন। রাজা রানীর শ্রীমুখ দিয়ে স্বপ্ন কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। রাজা এই সকল অলৌকিক স্বপ্নের কারণ জানতে চৌষট্টিজন বিখ্যাত জ্যোতিষীকে ডেকে আনলেন। জ্যোতিষীরা ভবিষ্যদ্বাণী করে বললেন, ‘রানী সন্তানসম্ভবা। আপনার রাজপুরী আলোকিত করে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করবে। এ ভাবী শিশু সংসারি হলে রাজচক্রবর্তী রাজা হবেন। আর সংসার ত্যাগ করলে সম্যক সম্বুদ্ধ হবেন। ’ তুষিত স্বর্গ থেকে চ্যুত হয়ে বোধিসত্ত্ব এভাবে আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিকে রাণী মহামায়ার গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন।

গৃহত্যাগ

সিদ্ধার্থ ছোট বেলা থেকেই চিন্তাশীল ছিলেন। সুযোগ পেলেই ধ্যান-মগ্ন হয়ে যেতেন। অফুরন্ত ভোগ সম্পদের আতিশয্যে তার জন্ম হলেও তিনি ক্রমশ সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠলেন। সংসারের প্রতি সিদ্ধার্থের বিতৃষ্ণাভাব এবং উদাসীনতা দেখে পিতা রাজা শুদ্ধোধন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। রাজার একান্ত অভিপ্রায় রাজপুত্র সিদ্ধার্থ রাজচক্রবর্তী রাজা হউক। চার দ্বীপমালা বেষ্টিত জম্বুদ্বীপের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করুক। অনেকটা তোড়জোড় করে ঊনিশ বছর বয়সে রাজকুমার সিদ্ধার্থকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা হলো কোলীয়রাজ দণ্ডপাণির রূপসী কন্যা, পতিব্রতা, নারী ধর্মের মর্যাদার মূর্তি যশোধারার সাথে। পূর্ণ হলো রাজা শুদ্ধোধনের মনের কামনা। কিন্তু না ! জন্ম যার বিশ্বকল্যাণে তিনি সংসার বাঁধনে বাধা থাকবেন কি করে! মোহ! সে তো ভোগীদের বাঁধন। ত্যাগীর সামনে দাঁড়াবে কি করে! ছোটবেলা থেকেই যিনি জীব ও জগৎ নিয়ে চিন্তামগ্ন তিনি রাজপ্রাসাদের নরম বিছানায় পড়ে থাকবেন কি করে! একদিন তিনি নগর ভ্রমণে যাওয়ার কথা বললেন পিতাশ্রীকে। কথাটি শুনে রাজার মনে হলো যেন ঘাঁয়ের উপর বিষফোঁড়া। রাজপ্রাসাদের ভোগ বিলাসের আতিশয্যে থেকেও যে জীবনের দুঃখমুক্তির কথা ভাবে সে কি না যাবে নগর ভ্রমণে! কিন্তু উপায় কি। সব তো পারমী আর দৈবলীলা। ঠেকায় কে? রাজার মহাজ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা মনে আরেক বার নাড়া দিয়ে গেল। রাজা হ্যাঁ বলতে বাধ্য হলেন। কিন্তু চেষ্টা তো চালিয়ে যেতে হবে। রাজা অমাত্যদের কড়া নির্দেশ দিলেন কোনো জরাগ্রস্থ, ব্যাধিগ্রস্থ, মৃতব্যক্তি ও সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী যাতে রাজকুমারের চোখ না পড়ে। অমাত্যরা তাদের ঠেকালেন। কিন্তু দেবরাজকে কে সামলাবে? সিদ্ধার্থ সারথি ছন্দককে নিয়ে রথে করে প্রথম বার গেলেন পূর্ব দিকে। কিছুদূর যেতে না যেতেই চোখে পড়ল এক জীর্ণশীর্ণ জরাগ্রস্থ ব্যক্তি। সিদ্ধার্থ চমকে উঠলেন। আরে সারথি থাম! থাম! সিদ্ধার্থের আত্মবিচলিত জিজ্ঞাসা-কোটরে পড়ে যাওযা দুটি চোখ, শরীর থেকে দুলে পড়েছে খসখসে চামড়া, কংকালের মতো অবয়ব, লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইনি কে? বেচারা সারথি ছন্দক নিরুপায়। না বলে যে উপায় নেই। ‘প্রভু, তিনি আমার আপনার মতো রক্তমাংসের গড়া একজন মানুষ। তার রূপ, যৌবন, শক্তি সামর্থ্য সবই ছিল। কিন্তু কালের স্রোত তাকে আজ এখানে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে। ’ সে এমনটি হতে চায় নি। সময় এবং জাগতিক বিধান তাকে এরকম করেছে। তার মা, বাবা, স্ত্রী, পুত্র, ঘর সংসার সবই আছে। রাখ! রাখ! সারথি আর নয় অনেক হয়েছে। আগে বল আমিও তার মতো হব কিনা। সারথির সহজ সরল প্রতি উত্তর- হ্যাঁ প্রভু, এটাই সংসারের ধর্ম। সেদিন আর নগর ভ্রমণ হলো না। মনে অনেক প্রশ্ন অনেক কষ্ট নিয়ে ফিরে গেলেন রাজমহলে। দ্বিতীয় বার বের হলেন দক্ষিণ দিকে। কিছু দূর যাওয়ার পরে সামনে পড়ে গেল এক ব্যাধিগ্রস্থ ব্যক্তি। একেবারে ক্ষীণপ্রাণ। যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। তার সর্বাঙ্গে মৃত্যুর ছাপ ভর করছে। না পারছে বাঁচতে না পারছে মরতে। তাকে দেখে সিদ্ধার্থ আরো বেশি বিচলিত হয়ে পড়েলন। সারথি ছন্দক বুঝিয়ে দিলেন তাকে জীবনের করুণ দুর্দশার কথা। সেদিন আর নগর ভ্রমণ হলো না, ভারাক্রান্ত মনে ফিরে গেলেন রাজপ্রাসাদে। তৃতীয়বার বের হলেন পশ্চিম দিকে। হঠাৎ চোখে পড়ল এক করুণ দৃশ্য। চারজন লোক কাঁধে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তিকে। ব্যক্তিটির কোনো সাড়া শব্দ নেই। তার পেছনে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে চলেছেন কিছু নারী-পুরুষ। তাদের বুকফাটা বিলাপে বেজে উঠছে প্রিয়হারার কান্নার সুর। সারথি বুঝালেন জীবনের শেষ পরিণতির কথা। যাকে বলে মৃত্যু। সিদ্ধার্থের ব্যাকুল প্রশ্ন মৃত্যু কি? সারথি বুঝানের চেষ্ঠা করলেন, জন্ম-মৃত্যু ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়। ঈশ্বর কে? জীব ও জগতের সৃষ্টিকর্তা। অর্থাৎ জীবের সুখ-দুঃখের কারক। তিনি মেনে নিতে পারলেন না সারথির যুক্তিকে। রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন, চিন্তায় বিভোর হয়ে গেলেন, খেতে, বসতে, চলতে, শুতে সর্বক্ষণ নগর ভ্রমণের ভয়ানক করুণ স্মৃতিগুলো তার চোখের পর্দায় ভেসে উঠে। তাকে বিচলিত করে তোলে।

চতুর্থ বার বের হলেন উত্তর দিকে। অনেক দূর গেলেন। কিছুই পড়ছে না সামনে। সারথির মনে কত দুশ্চিন্তা। এবার সামনে কি পড়ে কি জানি। সৌম্য শান্ত গৈরিক বসনধারী ভিক্ষাপাত্র হাতে অধঃদৃষ্টিতে ধীরমন্থর গতিতে এগিয়ে আসছেন কুমার সিদ্ধার্থের রথের দিকে এক সন্ন্যাসী। আহা! কি প্রশান্তি! তাঁর চোখে মুখে নেই কোনো কষ্টের ছাপ। তাঁকে দর্শনে মনে প্রশান্তি জেগে উঠল। ‘সারথি, ইনি কে ? সিদ্ধার্থের ভাবগম্ভীর প্রশ্ন। তিনি সংসারত্যাগী এক সন্ন্যাসী। ’ তাঁর উদ্দেশ্য কি? সংসারের যাবতীয দুঃখমুক্তির উপায় অন্নেষণে তিনি সন্ন্যাসী সেজেছেন। সারথির এই কথাগুলো সিদ্ধার্তের খুবই মনপুত হলো। নগর ভ্রমণের ইচ্ছা আর বেশিদিন স্থায়ী হল না। অনেকটা কৌতুহলী মনে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন। শান্ত সৌম্য ওই সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থের মনের ভাবনায় জোয়ার এনে দিলেন। রাজমহলের নরম বিছানা, ভোগ-বিলাস, আমোদ-প্রমোদ কিছুই সিদ্ধার্থকে রমিত করতে পারছে না। ওই দিকে রাজকুমারের নগর ভ্রমণের প্রতিদিনের খবর রাজা রাখতেন। সব ঘটনা রাজাকে রীতিমত ভাবিত করে তুললেন। কুমার সিদ্ধার্থ পিতাকে সংসার ত্যাগের ইচ্ছা নিবেদন করলেন। যেন আকাশ ভেঙে মাথায় পড়ল। রাজা অনেকটা নির্বাক হয়ে পড়ল। রাজা সংসারের সুখ এর বর্ণনাচ্ছলে পুত্রকে সংসারে বেঁধে রাখতে চাইলেন। কেউ কাউকে ছাড়ছেন না। অবশেষে পুত্র পিতার কাছে বর চেয়ে বসলেন। ‘পিতাশ্রী, জরা, ব্যাধি, মুত্যু যেন আমাকে স্পর্শ না করে। আমার এই রূপ যৌবন যেন চির অটুট থাকে। আমি যেন চির অমর হতে পারি। ’ পিতার নিরাশ উত্তর- ‘বৎস, আমি কেন পৃথিবীর কোনো পিতাই তার সন্তানকে এই বর দিতে পারে না। তুমি আমার রাজ্য, রাজত্ব চাও আমি তোমাকে এখনই দিয়ে দেব। ’ ‘না পিতাশ্রী, আমার এসব কিছুর প্রয়োজন নেই। আমি চাই দুঃখমুক্তি। ’ রাজা সর্বদা নাচে-গানে, আমোদ-প্রমোদে পুত্রকে মাতিয়ে রাখতে ব্যর্থ চেষ্ট করতেন।

একরাতে কুমার সিদ্ধার্থ ঘুমে মগ্ন হয়ে আছেন। পরিচারিকারাও নৃত্যগীতের পরে পরিশ্রান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর রাতে কুমার জেগে উঠলেন। কোথাও পিনপতন শব্দ নেই। রাতের নীরবতা সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। নিদ্রামগ্ন নর্তকীদের পরিহিত এলোমেলো বস্ত্র, বীভৎস চেহারা এবং দেহের বিকৃত রূপ মুহূর্তের মধ্যে কুমারের হৃদয়কে সংসারের প্রতি আরও বীতস্পৃহ করে তুলল। সুরম্য রাজপ্রাসাদ তার কাছে মহাশ্মশান মনে হলো। সে রাতেই তিনি সংসার ত্যাগ করার দৃঢ় সংকল্প নিলেন। সেদিনই ছিল শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি। দেবরাজ ইন্দ্র সিদ্ধার্থের সংসার ত্যাগ আসন্ন এবং গভীর রাতেই গৃহত্যাগ করবেন বুঝতে পেরে বিশ্বকর্মাকে প্রেরণ করলেন। ছদ্মবেশী দেবপুত্র সিদ্ধার্থকে অপূর্ব রাজপোশাক ও রাজমুকুটে সুসজ্জিত করলেন। সিদ্ধার্থ এই দিব্য অলৌকিক শক্তিকে অনুমান করতে পারলেন। পরম হিতৈষী পিতা রাজা শুদ্ধোধন, মমতাময়ী মাতৃদেবী মহাপ্রজাপতি গৌতমী, প্রিয়তমা স্ত্রী যশোধরা, প্রাণপ্রতিম পুত্র রাহুল, রাজৈশ্বর্য এবং প্রিয় প্রজাদের ভালোবাসার বাঁধন ছিন্ন করে ঊনত্রিশ বছর বয়সে মুক্তিকামী সিদ্ধার্থ সত্যের সন্ধানে গৃহত্যাগ করলেন।

ধর্মচত্র প্রবর্তন

গৃহত্যাগের পর রাজ নন্দন সিদ্ধার্থ সাধনায় নিমগ্ন হলেন। শুরু হলো দুঃখ মুক্তির অদম্য প্রচেষ্ঠা। ছয় বছর কঠোর সাধনা বলে অবশেষে তিনি অবর্তীণ হলেন কঠিন যাত্রায়। খুঁজে পেলেন মুক্তির পথের ঠিকানা। মানুষ কেন জন্ম-মৃত্যুর কবলে পড়ে, কে কোথায় যায়, কোথা হতে আসে, ইত্যাদি রহস্যময়তার সমাধান পেলেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর প্রথমে তিনি চিন্তা করেছিলেন যে তিনি ধর্ম প্রচার করবেন না। কারণ সাধারণ তৃষ্ণাতুর মানুষেরা এই তৃষ্ণাক্ষয়ী নৈর্বাণিক ধর্ম বুঝবে না। কিন্তু দেব-ব্রক্ষার অনুরোধে স্বর্গ-মর্ত্য সবার কল্যাণে ধর্ম প্রচার করার চিন্তা মনে স্থান দিলেন। অবশেষে বুদ্ধ সারনাথে সর্বপ্রথম ধর্মচক্র প্রবর্ত্তন করলেন। এর প্রাচীন নাম ঋষিপতন মৃগদায়। ঋষিগণ গন্ধমাধব পর্বত থেকে আকাশ পথে এসে সেখানে অবতরণ করতেন। ঋষিদের পতন স্থান বলে সারনাথের অপর নাম ছিল ঋষিপতন। হত্যা করার জন্য আনীত মৃগদের সেখানে ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে ইহার আরেক নাম মৃগদায় অর্থাৎ মৃগবন। প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কীয় বিষয়ের জন্য সারনাথ সুপ্রসিদ্ধ। অশোক স্তূপের পূর্ব পাশে যে মন্দিরের চিহ্ন বিরাজমান সেটাই ধর্মচক্র প্রবর্ত্তন স্থান। প্রত্যেক সম্যক সম্বুদ্ধের এই স্থানই প্রথম ধর্ম প্রচার স্থান। এই স্থান অপরিবর্তনীয়। প্রথম ধর্মদেশনায় ১৮ কোটি দেব-ব্রহ্মা জ্ঞান লাভ করেছিলেন। মানুষের মধ্যে একজন মাত্র জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যার নাম কৌন্ডিন্য। সেদিন ছিল শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা। শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিনে বুদ্ধের জীবনে আরেকটি অলোকিক ঘটনা ঘটেছিল। সেই নান্দনিক ঘটনাটি হলো শ্রাবস্তীর গণ্ডাম্ব্র বৃক্ষমূলে বুদ্ধের ঋদ্ধি প্রদর্শন ও স্বর্গারোহন।

শ্রাবস্তীতে ঋদ্ধি প্রদর্শন

বুদ্ধের সময় আরো ছয়জন শাস্তা ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশে ছিলেন নগ্ন সন্ন্যাসী। এক এক জনের মতবাদ ছিল এক এক রকম। নিজেদের দৃষ্টিতে যা ভালো মনে হয়েছে তা ভক্তদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। মূলত তাঁরা কেউ সাধক কিংবা সত্য সন্ধ্যানী ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন তীর্থিক। তাঁদের একজন সঞ্জযো বেলটুঠপুত্তো নামক শাস্তা অতি ধুরন্ধর প্রকৃতির ছিলেন। তার বাদ ছিল অমরা বিক্ষেপ। কিছুতেই ধরা দিতেন না। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘আমি এইরূপও বলি না, সেইরূপও বলি না। অন্যথাও আমি বলি না, না বলিয়াও আমি বলি না। ’ এমন উত্তর দিয়ে বাক্য বিক্ষেপ বা অমরা বিক্ষেপ করতেন। এমন কৌশল গ্রহণ করার কারণ ছিল মিথ্যা ধরা পড়ার ভয়, যেহেতু কিছুই তিনি সঠিকভাবে জানতেন না। সেই সময়ের মহারাজ অজাতশত্রু তার উত্তর শুনে বলেছিলেন, ছয় শাস্তার মধ্যে এ ব্যক্তি সবচেয়ে অজ্ঞানী। গৌতম বুদ্ধের কারণে তাদের লাভ সৎকারে ভাটা পড়ছিল। তাই তারা বুদ্ধের বিরুদ্ধে বলতেন। বিভিন্ন মিথ্যা অপপ্রচার এবং রটনা রটাতেন। তারা বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধের চরিত্রে কলংক লেপনের চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু কখনো সফল হতে পারেননি। বুদ্ধ এবং বুদ্ধের জ্ঞান এবং শক্তি সম্পর্কে তারা সম্যক অবগত ছিলেন না। তাদের শিষ্যরা বলে বেড়াতেন, বুদ্ধ তাদের চেয়ে অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন নয়। অলৌকিক শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা হলে বুদ্ধ হেরে যাবেন। ইত্যাদি কথা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতেন। বুদ্ধের শিষ্য এবং অনুসারীরা বুদ্ধকে এসব কথা বলতেন। কিন্তু সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী বুদ্ধ এসব কথায় গুরুত্ব দিতেন না। পরে বুদ্ধ ভাবলেন এই অপপ্রচারে যদি মানুষের ভেতরে বুদ্ধের প্রতি কোনো সন্দেহ এবং অশ্রদ্ধা উৎপন্ন হয় কিংবা যারা অপপ্রচারে লিপ্ত আছেন তাদের পাপ হবে। এই সন্দেহ এবং দ্বন্দ্ব দূর করা প্রয়োজন। ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠা সমাপ্ত হলে ষষ্ঠ বর্ষাযাপনের জন্যে ভগবান বুদ্ধ প্রয়াস করলেন রাজগৃহের অন্তঃপাতী মকুল পর্বতে। এই সময়ে রাজগৃহ শ্রেষ্ঠী জম্বুদ্বীপে প্রকৃত অর্হৎ আছেন কিনা পরীক্ষা করবার জন্যে একটি ৫০ হাত সুদীর্ঘ বংশদণ্ডের অগ্রভাগে একটি মহামূল্য চন্দন কাষ্ট নির্মিত পাত্র স্থাপন করে ঘোষণা করে দিলেন, ‘ঋদ্ধি বলে কেহ যদি শূন্যে উত্থিত হয়ে ওই পাত্রটি গ্রহণ করতে পারেন তবে উহা তাঁরই হবে। ’ আয়ুস্মান মহামৌদ্গল্যায়ন ও পিণ্ডোল ভরদ্বাজ রাজগৃহ নগরে ভিক্ষা চর্য্যায় বের হয়ে সন্ন্যাসীদের এই হঠকারিতা ও বিভ্রান্তি অবলোকন করেন। ভিক্ষা চর্যার পর মহামৌদ্গল্যায়ন নির্দেশক্রমে শ্রেষ্ঠী প্রদত্ত সেই চর্তুমধুর ভাণ্ডটি নেবার জন্য অভিজ্ঞাপাদক ধ্যান অনুশীলন করে বিরাট এক খণ্ড মেঘ সৃষ্টি করে, আকাশ পথে ভ্রমণ করছিলেন। জন সাধারণ স্থবিরের এই অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপ দর্শনে বিস্মিত হল এবং জনগণ বলতে শুরু করল যে, ভদন্ত পিণ্ডোল ভারদ্বাজ, আপনি আমাদের ত্রাণ করুন। স্থবির মহোদয় তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আকাশের মেঘ খণ্ড অপসারিত করে বংশাগ্রে স্থিত সেই চর্তুমধুর ভাণ্ডটি আপন হাতে নিয়ে ভূমিতে নেমে আসলেন এবং বেণুবন বিহারের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে দলে দলে লোক তাঁর পশ্চাৎ অনুগমন করল। তীর্থিকদের মধ্যে কেহই উহা গ্রহণ করতে সমর্থ হল না। আয়ুস্মান মৌদ্গল্যায়নের নির্দেশে ‘পিণ্ডোল ভারদ্বাজ’ নামক জনৈক ভিক্ষু ঋদ্ধি বলে পাত্রটি গ্রহণ করেন। ভগবান বুদ্ধ উহা জানতে পেরে ভিক্ষুদের পক্ষে কাষ্ঠনির্মিত পাত্রের ব্যবহার এবং ঋদ্ধি প্রদর্শন উভয়ই নিষিদ্ধ করে দেন। এতে তীর্থিকেরা বলে বেড়াতে লাগল যে শাক্যপুত্রীয় শ্রমণেরা ঋদ্ধি প্রদর্শন করলে আমাদের সাথে পেরে উঠবে না। তাই শাক্যপুত্র গৌতম তাঁর শিষ্যদের ঋদ্ধি প্রদর্শনে নিষেধ করেছেন। বুদ্ধ বললেন আমার শিষ্যরা ঋদ্ধি প্রদর্শনে নিষিদ্ধ হলেও প্রয়োজন বোধে আমি নিজে উহা প্রদর্শন করতে পারি।

স্থির হলো চার মাস পরে শ্রাবস্তীর গণ্ডাম্ব বৃক্ষ মূলে তিনি তাঁর ঋদ্ধি প্রদর্শনের এই প্রতিশ্রুত রক্ষা করবেন। তীর্থিকেরা এ সংবাদ পেয়ে নির্দিষ্ট স্থানের চতুর্দিকে এক যোজনের মধ্যে যত আম্রবৃক্ষ আছে সমস্ত উৎপাটিত করে ফেলল। নির্দিষ্ট দিনে যথা স্থানে উপস্থিত হয়ে ভগবান বুদ্ধও জনসংঘ দেখলেন। আশেপাশে আম্র বৃক্ষের চিহ্নও বিদ্যমান নেই। রাজ্যেদ্যানের মালী গ- কোথা থেকে একটি পক্ক আম্রসংগ্রহ করে এনে ভগবানকে উপহার দিলেন। তিনি তাকে উহা মাটিতে পুতিতে আদেশ দিলেন। অতঃপর ভগবান ব্দ্ধু উহার উপরে হাত ধুয়ে জল দেওয়া মাত্র ইহা ৫০ হস্ত দীর্ঘ এক মহীরুহে পরিণত হয়। তখন ভগবান বুদ্ধ ঋদ্ধি বলে শূণ্যের উপর এক মণিময় বিহার ভূমি রচনা করে। তদুপরি উঠে ‘যমক প্রতিহার্য প্রদর্শন করেন। প্রথমে ভগবান বুদ্ধ শূণ্যে উত্থিত হন তাঁর উর্দ্ধাঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা উত্থিত হয় ও নিম্নাঙ্গ থেকে বারিধারা বর্ষিত হতে থাকে। অতঃপর উর্দ্ধাঙ্গ থেকে বারিধারা ও নিম্নাঙ্গ থেকে অনলশিখা প্রবর্তিত হতে থাকে। তারপর পর্যায়ক্রমে ডানপার্শ্ব থেকে অগ্নি ও বাম পার্শ্ব থেকে জল, ডান পার্শ্ব থেকে জল বাম পার্শ্ব থেকে অগ্নি প্রবর্তিত হতে থাকে। এভাবে ক্রমান্বয়ে বাইশ প্রকার ঋদ্ধি প্রদর্শন সমাপ্ত হলে তিনি জনগণকে এমন ভাবে মোহাবিষ্ট করলেন যে তাদের মনে হল তিনি উক্ত মণিময় বিহার ভূমিতে দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে থেকে বিভিন্ন প্রকারের দৃষ্টি বিভ্রান্তি ঘটালেন। বিভিন্ন ধরণের হৃদয়ছোঁয়া ঘটনাবলির কারণে আষাঢ়ী পূর্ণিমা একটি অনন্য পূর্ণিমা তিথির নাম। বৌদ্ধদের জন্য আষাঢ়ী পূর্ণিমা পূণ্যের সুবাসী বারতা নিয়ে হাজির হয়। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই তিনমাস ভিক্ষুসংঘের পাশাপাশি বৌদ্ধ উপাসক-উপাসিকারাও বর্ষাবাস পালন করে থাকেন। এই সময়ে তারা প্রতি উপোসথ দিবসে অষ্টশীল গ্রহণ, দানকর্ম, ভাবনাকার্য সহ ইত্যাদি পূণ্যকর্মের মাধ্যমে বর্ষাবাস পালন করে থাকেন। এই সময়ে পূজনীয় ভিক্ষুসংঘরা তথ্য বহুল অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মদেশনা উপাসক উপাসিকাদের দান করেন। পাপকর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য সাধারণ গৃহিরা সাধ্যমত চেষ্ঠা করেন। প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকেন। এমনকি এই তিন মাসের মধ্যে সামাজিক অনুষ্ঠান বিয়ের অনুষ্ঠানও হয় না। ভিক্ষুসংঘরাও বর্ষাবাস চলাকালীন সময়ে কেউ বিহারের বাইরে থাকতে পারেন না। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে থাকার নিয়ম থাকলেও এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসতে হয়।




রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২২

অগ্রদূত বৌদ্ধ সংগঠনের ৬ষ্ট বর্ষপূর্তি এবং ৭ম বর্ষে পদার্পণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন

অগ্রদূত বৌদ্ধ সংগঠনের ৬ষ্ট বর্ষপূর্তি এবং ৭ম বর্ষে পদার্পণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন



গত ২৫ নভেম্বর ২০২২ ইং তারিখ রোজ শুক্রবার "অগ্রগতির অর্ধযুগে অগ্রদূত"-এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে অগ্রদূত বৌদ্ধ সংগঠনের অগ্রগামী তরুণ সদস্যরা তাদের প্রিয় সংগঠনের ৬ষ্ঠ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সেবামূলক কার্যক্রমের আয়োজন করে। ।



উদযাপন পরিষদের সদস্য সচীব শ্রীমাণ সুষ্ময় বড়ুয়া-এর সঞ্চালনায় এবং পরিচালনায় আয়োজিত অনুষ্ঠানের সর্বপ্রথম সংগঠনের সকল সদস্য সকাল ৮ঘটিকায় নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহার, চট্টগ্রাম-এ মিলিত হয়। এরপর সকালবেলার বুদ্ধ পূজা দানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষপূর্তির নানা আয়োজন। বুদ্ধ পূজা শেষে বাসযোগে সদস্যরা সকলে চট্টগ্রামস্থ জোবরা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা করে। নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবেষ্টিত জোবরা গ্রামের একটি অনাথ আশ্রমে অবস্থানরত সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের সাথে ছিল সারাদিন জুড়ে বর্ষপূর্তির নানা আয়োজন। জোবরা গ্রামের অন্তর্গত সুগত বিহারে বুদ্ধ পূজা ও বুদ্ধ বন্দনাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যক্রম দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভসূচনা করা হয়। পরবর্তীতে অনাথ আশ্রমের শিশু-কিশোরদের নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি শ্রীমাণ প্রত্যয় বড়ুয়া নিলয়। এতে উদ্বোধনী সংগীত, জাতীয় সংগীতসহ আরো অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহ অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় পর্বে শ্রীমাণ উৎস বড়ুয়ার পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের বিনোদন এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলজ খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগিতা শেষে সকল শিশু-কিশোরদের সাথে নিয়ে সংগঠনের সদস্যদের মধ্যাহ্নভোজ সম্পন্ন হয়। 



তৃতীয় পর্বে ঠিক বিকেল ৩টায় বৈকালিক বুদ্ধ বন্দনা, পঞ্চশীল গ্রহণ, অষ্টপরিষ্কার দান, পানীয় এবং অন্যান্য দানসামগ্রী দান, সূত্রপাঠ এবং ধর্মোপদেশ শ্রবণ করেন উপস্থিত সকল শিশু-কিশোর, সংগঠনের সদস্যসহ গ্রাম থেকে আগত পূণ্যার্থী তথা দায়ক-দায়িকাগণ। 

এতে ধর্মীয় বিভিন্ন দিকনির্দেশনামূলক ধর্মোপদেশ প্রদান করেন জোবরা সুগত বিহারের উপাধ্যক্ষ ভদন্ত নিরোধানন্দ ভিক্ষু মহোদয়। এছাড়াও সংগঠনের সম্মানিত উপদেষ্টা শ্রীমাণ সুজয় বড়ুয়া সংগঠনের ইতিপূর্বের বিভিন্ন কার্যক্রমসমূহ উপস্থাপনসহ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সংগঠনের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করে বক্তব্য প্রদান করেন। উক্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আশীর্বাদক হিসেবে অংশ নেন জোবরা সুগত বিহারের অধ্যক্ষ কর্মযোগী ভদন্ত শীলরক্ষিত মহাথের মহোদয়। শ্রদ্ধেয় ভান্তের শারীরিক অবস্থা দেখে সংগঠনের উপদেষ্টা শ্রীমাণ সুজয় বড়ুয়া এবং সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি শ্রীমাণ প্রত্যয় বড়ুয়া নিলয় অগ্রদূত বৌদ্ধ সংগঠনের সকল সদস্যদের পক্ষ হতে ভান্তের চিকিৎসার জন্য শ্রদ্ধাদান প্রদান এবং ভান্তের সুস্থজীবন প্রার্থনা করেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষে শ্রদ্ধেয় ভান্তের হাত দিয়ে বর্ষপূর্তির কেক কর্তন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। এছাড়াও, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ এবং বিভিন্ন ইভেন্টে বিজয়ীদের মাঝে পুরষ্কার প্রদান করা হয়। শিক্ষা উপকরণসমূহ হাতে পেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মুখ হাসি ও আনন্দে ভরে ওঠে। সর্বশেষ পর্বে, সংগঠনের সকল সদস্যগণ জোবরা গ্রাম হতে নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহারে পঞ্চশীল গ্রহণসহ ফানুস উত্তোলন করা হয়।সংগঠনের একনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল সদস্যা শ্রীমতী প্রজ্ঞা বড়ুয়া-এর তত্ত্বাবধানে ৬ষ্ঠ বর্ষপূর্তি-কে কেন্দ্র করে হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে জগতের সকল প্রাণির সুখ কামনা করে দিনের কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

উল্লেখ্য, বর্ষপূর্তি উদযাপনকে কেন্দ্র করে ১২ সদস্য বিশিষ্ট উদযাপন পরিষদ গঠন করা হয়। আহ্বায়ক শ্রীমাণ অনিন্দ্য বড়ুয়া এর আহ্বানে সংগঠনের প্রিয়মুখ শ্রীমাণ সুস্ময় বড়ুয়া-কে প্রধান অর্থাৎ সদস্য সচীব করে উদযাপন পরিষদটি গঠিত হয়। এতে আরো ছিলেনঃ অর্থসচীব-শ্রীমাণ প্রত্যয় চৌধুরী রিদ্দি, প্রধান সমন্বয়কারী-শ্রীমাণ উৎস বড়ুয়া, সমন্বয়কারী-শ্রীমতি প্রজ্ঞা বড়ুয়াসহ সংগঠনের অন্যান্য ৭জন সদস্য-সদস্যা

শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২২

জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২২ পেলেন  জয় বড়ুয়া লাভলুর রোবোলাইফ টেকনোলজিস

জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২২ পেলেন জয় বড়ুয়া লাভলুর রোবোলাইফ টেকনোলজিস

তারুণ্যের সর্ববৃহৎ প্লাটফর্ম ইয়াং বাংলার জনপ্রিয় আয়োজন জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ডের ষষ্ঠ আসরের বিজয়ীদের নাম ঘোষিত হয়েছে। শনিবার (১২ নভেম্বর) দুপুরে বিজয়ীদের হাতে জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২২ তুলে দেন সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের চেয়ারপারসন সজীব ওয়াজেদ জয়।

নতুন উদ্ভাবনী ভাবনা নিয়ে দেশ গঠনে এগিয়ে আসা ৬০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন থেকে যাচাই বাছাই শেষে ১০ প্রতিষ্ঠানের হাতে উঠেছে ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’।এ বছর পাঁচটি ক্যাটাগরির প্রতিটিতে দুটি করে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।

উদ্ভাবনী ক্যাটাগরিতে কৃত্রিম হাত তৈরি ও প্রতিস্থাপনের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন রোবোলাইফ টেকনোলজিস। জয় বড়ুয়া লাবলু রোবোলাইফ টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও।২০১৮ সালে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের সহযোগিতায় এ সংগঠন যাত্রা শুরু করে। শুরুতেই তারা দুর্ঘটনা বা যেকোনও কারণে হাত হারানো ব্যক্তিদের কৃত্রিম হাত প্রতিস্থাপন করা শুরু করে। এভাবে অন্তত ২০ জনকে সহযোগিতা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে তারা ৩০ হাজার টাকায় কৃত্রিম হাত প্রতিস্থাপন করছে ও এর খরচ কমিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে সৌদি আরব ও তুরস্কে বেশ কিছু কৃত্রিম হাত রফতানিও করেছে এই প্রতিষ্ঠান।রোবোলাইফ টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জয় বড়ুয়া লাবলু বলেন, এ পুরস্কার আমাদের আরও সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। বাংলাদেশে যে হাত-পা বিহীন মানুষ আছে, তাদের জন্য এই রোবোটিক অঙ্গ দৈনন্দিন কাজ সম্পন্ন করতে সহায়তা করে। ভবিষ্যতে আরও কাজ করতে এই পুরস্কার আমাদের উৎসাহ দেবে।

শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

দান, সেবা ও মানবতার শিক্ষা - মধু পূর্ণিমা

দান, সেবা ও মানবতার শিক্ষা - মধু পূর্ণিমা



আজ শুভ মধু পূর্ণিমা। বৌদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসে এটি অন্যতম এক শুভ তিথি। বিশেষ করে বর্ষাবাসের দ্বিতীয় পূর্ণিমাতে এটি উদযাপিত হয়। বর্ষাবাসের দ্বিতীয় পূর্ণিমা তিথি ভাদ্র মাসে এই উৎসব উদযাপন করা হয়। তাই এর অপর নাম ভাদ্র পূর্ণিমা।

তবে বিশ্বে এটি ‘মধু পূর্ণিমা’ নামে পরিচিত। বুদ্ধ জীবনের নানা ঘটনা এবং দান, ত্যাগ ও সেবার নানা মহিমায় দিবসটি ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দিক থেকে বেশ গুরুত্ব বহন করে।

মধু পূর্ণিমার শুভ এ দিনটি বৌদ্ধরা নানা উৎসব, আনন্দ ও আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করেন। নানা শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ এদিন বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘকে মধুদান করার জন্য উৎসবে মেতে ওঠেন। বিহারে দেখা যায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মধুদানের এক আনন্দঘন পরিবেশ। বিহারে সন্ধ্যায় বৌদ্ধকীর্তন ও পুঁথিপাঠ করা হয় এবং বিশ্ব শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা ও প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়।

আমরা জানি, মহাকারুণিক ভগবান বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর মোট ৪৫ বছর বর্ষাবাসব্রত পালন করেন অরণ্য, পর্বত, গুহা, বিহার ইত্যাদি নানা স্থানে। তার মধ্যে দশম বর্ষাবাস যাপন করেন পারিলেয়্য নামক বনে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিবাদ ও বিনয় সম্পর্কিত নানা অসন্তোষ আচার-আচরণের কারণে তিনি সেই পারিলেয়্য বনে গিয়েছিলেন। কোসাম্ভীর ঘোষিতারামে দু’জন পণ্ডিত ভিক্ষুর মধ্যে ক্ষুদ্র একটি বিনয় বিধান নিয়ে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়। তারা উভয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে সংঘভেদ করেন। স্বয়ং ভগবান বুদ্ধ তাদের এ মতবিরোধ মেটানোর জন্য শ্রাবস্তী থেকে সেখানে আসেন এবং বিরোধ মিটিয়ে দিয়ে পুন শ্রাবস্তীতে প্রত্যাবর্তন করেন। বুদ্ধ চলে যাওয়ার পর তাদের মধ্যে আবার বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং একে অপরকে দোষারোপ করেন।

এতে তাদের অনুসারী ভিক্ষুসংঘের মধ্যেও বিরোধ দেখা দেয়। বুদ্ধ দেখলেন, তারা নিজেরা নিজেদের আত্মকলহে জড়িয়ে তাদের অনুসারীদের মধ্যে একটি বিভাজন তৈরি করে দেন, যা সংঘ ও সদ্ধর্ম-শাসনের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। বৌদ্ধ পরিভাষায় একেই বলে ‘সংঘভেদ’। তখন বুদ্ধ একাকী বসবাসের পরিকল্পনা করে বালুকারাম বিহারে চলে যান এবং তার শিষ্য ভৃগু স্থবির ও শিষ্যম্ললীকে নিয়ে চারিকাব্রত করেন

। পরে প্রাচীন বংশরক্ষক মৃগদায়ের দুই কুলপুত্রকে মৈত্রী ও মিলন সম্পর্কে উপদেশ দিয়ে পারিলেয়্য বনে চলে যান এবং সেই বনের একটি ভদ্রশাল রক্ষিত বৃক্ষমূলের বনসন্ডে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। সেখানেই তিনি তিন মাস যাপন করেন, ধ্যান-সমাধি করেন। সে বনে ছিল নানা পশুপাখি ও জীবজন্তুর আবাস। বুদ্ধের অপরিমেয় মৈত্রী ও করুণার প্রভাবে বনের সেসব পশুপাখি ও জীবজন্তু তাদের হিংস্রতা পরিহার করে।

ভাদ্র মাসের এ পূর্ণিমার সঙ্গে বুদ্ধজীবনে বানরের মধুদানের এক বিরল ঘটনা জড়িয়ে আছে। সেদিনের বানরের মধুদান বৌদ্ধ ইতিহাস ও সাহিত্যে একটি নিছক ঘটনা মনে হলেও এ থেকে আমরা সেবা, ত্যাগ ও দানচিত্তের এক মহৎ শিক্ষা পেয়ে থাকি।

বনের একটি বানর হয়ে বুদ্ধকে দান দিয়ে যেখানে তার মহৎ উদারতা ও ত্যাগের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে, তৃপ্তি পেয়েছে এবং আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে, সেখানে আমরা মানুষ হয়েও আজ বিপন্ন মানুষের প্রতি সেই উদারতা, ত্যাগ ও দানের মহিমা দেখাতে পারছি না।

আজ বিবেকের কাছে আমাদের প্রশ্ন- মানবতা, সেবা আর ত্যাগে আমাদের চিত্তকে কি আমরা সেভাবে প্রসারিত করতে পারি না? মধু পূর্ণিমা আমাদের সবার জীবনে শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনুক। আমাদের হৃদয় ভরে উঠুক অপার মৈত্রী-করুণায় এবং দান, দয়া, সেবা আর অকৃত্রিম ভালোবাসায়। সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু- জগতের সকল জীব সুখী হোক। ভবতু সব্ব মঙ্গলং- সকলের মঙ্গল লাভ হোক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হোক। বিশ্বে শান্তি বর্ষিত হোক।

প্রফেসর ড. সুকোমল বড়ুয়া : সাবেক চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টার

মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২

দ্রব্যমূল্যের চড়া দামে ফানুস বানাতে বেগ পেতে হচ্ছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের

দ্রব্যমূল্যের চড়া দামে ফানুস বানাতে বেগ পেতে হচ্ছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের

 

ছবিটি চট্টগ্রাম নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহার থেকে তোলা
নিলা চাকমা:
অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে পালিত হবে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা। অনেকে আশ্বিনী পূর্ণিমাও বলে থাকেন। পবিত্র এ দিনটিতে গৌতম বুদ্ধের কেশ ধাতুর প্রতি পূজা ও সম্মান প্রর্দশনের জন্য ফানুস উড়ানো হয়। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মন্দিরগুলোতে  ফানুস বানানোর ধুম পড়েছে।

গত শুক্রবার চট্টগ্রাম নন্দনকান বৌদ্ধ বিহারেও ফানুস বানাতে ব্যস্ত দেখা যায় তরুণদের। কয়েক বছরের তুলনায় এবারের ফানুস বানানোর সব উপদান দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করছেন তারা।

সাধারণত ফানুস বানাতে দরকার কাগজ , গাম, বাঁশ , কাপড়, মোম, বতিসহ নানা উপাদান। এসব উপাদানগুলোর মধ্যে আবার কোনটার দাম বেড়েছে ৫০ টাকা, কোনটার দাম বেড়েছে ২ শ টাকা থেকে ৩ শ টাকা। ফানুস বানানোর সবচেয়ে দরকারী উপাদান হলো কাগজ।

মঙ্গলবার(০৬ সেপ্টেম্বর ) আন্দরকিল্লা বাজার ঘুরে দেখা যায়,  সিংগেল লেয়ারের কাগজের বর্তমান মূল্য ৭০০ টাকা, ডাবল লেয়ারের মূল্য ১২৭০-১৩০০ টাকা। যেটা দুয়েক সপ্তাহ আগে এর মূল্য ছিলো যথাভাবে ৫৫০ টাকা এবং ১১ শ টাকা। এর আগের বছর কাগজটির মূল্য ছিলো ৪০০ থেকে ৮৫০ টাকা পর্যন্ত। ফেবিকল গামের লিটার প্রতি বেড়েছে ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকা। একই সাথে প্রতি প্যাকেট মোম বাতির দাম বেড়েছে ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাগজ বিক্রেতা জানান, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মালামাল পরিবহনে বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে আমাদের। সেই সাথে কারখানায় চাহিদা মাফিক কাগজ উৎপাদন না হওয়ায় এ বছর কাগজের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামনে আরও বৃদ্ধি পাওয়ারও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।

এদিকে দেওয়ানহাটের বাঁশ বিক্রির দোকানেও দাম বাড়ার একই চিত্র লক্ষ্য করা যায়।ফানুস বানানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বাঁশ । তবে যেকোনো বাঁশ  দিয়ে বানানো যায় না। ফানুস বানাতে দরকার হয়  মুলি বাঁশ। বড় মুলি বাঁশের বর্তমান মূল্য ১৭০ টাকা, ছোট ৯০ টাকা। যা গত বছর ছিলো ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। পরিবহনে বাড়তি টাকা গুনতে হওয়ায় এ বছর বাঁশের দাম বৃদ্ধি বলে জানান বিক্রেতারা।

দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তরুণ বৌদ্ধ সংগঠনগুলো। অগ্রদূত বৌদ্ধ সংগঠনের সভাপতি প্রত্যয় বড়ুয়া জানান, আমাদের  সংগঠনের দুয়েক জন বাদে সবাই শিক্ষার্থী। সংগঠনের সদস্যদের থেকে কিঞ্চিত চাঁদা তুলে আমরা প্রতি বছর ফানুস উত্তোলনের আয়োজন করি। কিন্ত সব জিনিসের দাম বাড়ায় আমাদের চাঁদার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে।  শিক্ষার্থী হওয়ায় অনেকের চাঁদা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই দামটা সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকি কামনা করছি।

নন্দন সংগঠনের সভাপতি অতনু বড়ুয়া বলেন, এবার কাগজ, গাম, বাঁশ সব উপাদান চড়া মূল্য কিনতে হচ্ছে আমাদের। পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের চাঁদা ছাড়া আর অন্য কোন অর্থ নেই। আমাদের সামান্য অর্থে প্রতি বছর শ খানেক ফানুস উত্তোলন হয় সংগঠন থেকে কিন্ত এবার জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় আমরা ৪০টা টার্গেট দিয়েছি। আমাদের এ সামান্য চেষ্টায় বৌদ্ধ সিনিয়র সংগঠনের সহোযোগিতা কামনা করছি।

সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উদ্যোগে দানের টাকায় শ্রীলঙ্কার প্রতি কৃতজ্ঞ পূজা

বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উদ্যোগে দানের টাকায় শ্রীলঙ্কার প্রতি কৃতজ্ঞ পূজা

প্রতিবেদন - বিপসসী ভিক্ষু

বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উদ্যেগে আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, স্পেন, থাইল্যান্ড, দুবাই ও বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সহযোগিতায় গত ৩০শে আগষ্ট কলম্বো Sri Ganaseeha Viharaya তে বিশেষ কৃতজ্ঞ পূজার আয়োজন করা হয়।

 Sri  Suvarati Maha viddalaya এর সহকারী শিক্ষক Panamure Rahula Thero এর উপস্থাপনায় উক্ত আয়োজনে সভাপতির আসন অলংকৃত করেন শ্রীলঙ্কার ভিক্ষু সংঘের( Ramañña Maha Nikaya) মহামান্য অনুনায়ক Dr. Venrable Waleboda Gunasiri Nahimi. 

প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- Sri Lanka Ramañña Maha Nikaye Western Province Chief Sangha Nayaka Prof. Most Venerable Medagama Nandawansa Nahimi. 

প্রধান অতিথির(Chief Guest) আসন অলংকৃত করেন-Mr. Md. Reyad Hossain, Counsellor(political) Bangladesh High Commission. 

বিশেষ অতিথি ছিলেন যথাক্রমে -Director of Piriven Education Most Venerable Watinapaha Somananada Nahimi, Most Venerable Akuresse Ariyasagara Nahimi প্রাদেশিক সভার সেক্রেটারি Mrs. Dhammikaa Bikramasingha এবং 

Honorable guest হিসেবে উপস্থিত ছিলেন Mr. Md. Nizamul Islam, Third Secretary, Bangladesh High Commission. 

বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা ও শ্রীলঙ্কা ভিক্ষু সংঘের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে নাগেশ্বর চারা রোপনের মধ্যে দিয়ে কৃতজ্ঞ পূজার উদ্বোধন করা হয়। 

উক্ত কৃতজ্ঞ পূজার উদ্বোধন করেন-Most Venerable Soriyawewa Somananda Nahimi , Principle of Sri Lanka Maha Piriven and Sri Ghananaseeha Viharaya, Colombo. 

বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার পক্ষে লিখিত সূচনা বক্তব্য পাঠ করেন BBSCSL এর সভাপতি বিপসসী ভিক্ষু এবং তা সিংহলি ভাষায় উপস্থাপন করেন শ্রীমৎ অশ্বজিত ভিক্ষু। 

সুচনা বক্তব্যে বিপসসী ভিক্ষু বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক সম্পর্ক, বাংলাদেশ হতে বুদ্ধের পবিত্র চুল ধাতু প্রদান, কৃতজ্ঞ পূজার প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ভিক্ষুসংঘের যৌথ সামাজিক উন্নয়নের গুরত্ব আলোচনা করেন। 

বাংলাদেশী বৌদ্ধদের জন্যে শ্রীলঙ্কার ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরনের উপর গুরুত্বারোপ করে প্রধান অতিথি মোহাম্মদ রিয়াদ হোসাইন বলেন, শ্রীলঙ্কা তার বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা দূর করতে পারে পর্যটন খাতকে উম্মুক্ত করে। 

বাংলাদেশী বৌদ্ধরা শ্রীলঙ্কায় তীর্থভ্রমণের সুযোগ পেলে তা শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখবে। তিনি বাংলাদেশী বৌদ্ধদের এমন মানবিক উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশী বৌদ্ধদের শারিরীক গঠন, বর্ণ, সংস্কৃতি এবং একই বুদ্ধের আর্দশ অনুশীলন করে বলে মত প্রকাশ করেন প্রধান আলোচক -Sri Lanka Ramañña Maha Nikaye Western Province Chief Sangha Nayaka Prof. Most Venerable Medagama Nandawansa Nahimi. তিনি আরো বলেন এই কৃতজ্ঞ পূজায় তিনি অনেক আনন্দিত।

শ্রীলঙ্কার ভিক্ষু সংঘও জনগণ বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভাসহ সকল সহযোগিতাকারি বাংলাদেশী বৌদ্ধদেরদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ পূজার সভাপতি -Sri Lanka Ramañña Maha Nikaye Anunayaka Dr. Most Venrable Waleboda Gunasiri Nahimi তাঁর বক্তব্যে বলেন- কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ব্যক্তি দুর্লভ। তিনি ইতিপূর্বে কখনো এই ধরনের আয়োজন দেখেন নি।বাংলাদেশী বৌদ্ধদের তিনি ধন্যবাদ প্রদান করেন এবং বাংলাদেশ ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশ করেন।

একই সাথে শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশী বৌদ্ধ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহনের জন্যে সুযোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কৃতজ্ঞ পূজা আয়োজনটি Love from Bangladesh শিরোনামে ফেইসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করে দি বুড্ডিস্ট টিভি। 

উল্লেখ্য বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উদ্যেগে বাংলাদেশ, আমেরিকা, ফ্রান্স, স্পেন,দুবাই, থাইল্যান্ডে অবস্থানকারী বৌদ্ধদের সহযোগিতায় প্রথম পর্যায়ে ১২০ টি পরিবার, ২ টি বৌদ্ধ বিহার ও পিরিবেনে ৫ লক্ষ ৯৬ হাজার রুপির খাদ্যসামগ্রী প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে আরো ২৮ লক্ষ রুপির খাদ্য ও শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করে কৃতজ্ঞ পূজা করা হবে। উক্ত কৃতজ্ঞ পূজায় যারা সহযোগিতা করছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হয়।   

কৃতজ্ঞ পূজা বাস্তবায়নে সার্বিক সহযোগিতা করেছে Bangladesh Buddhist Student Council of Sri lanka এর সদস্যবৃন্দ।



মঙ্গলবার, ২২ জুন, ২০২১

অবশেষে ক্যান্সারের কাছে হেরে গেলেন ডা . তরুন তপন বড়ুয়া

অবশেষে ক্যান্সারের কাছে হেরে গেলেন ডা . তরুন তপন বড়ুয়া

 

অবশেষে না ফেরার দেশেই পাড়ি জমালেন ডা . তরুন তপন বড়ুয়া।ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়াইয়ের পর আজ মঙ্গলবার (২২ জুন) স সকালে নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৫১ বছর।

ডা . তরুন তপন বড়ুয়া পেশাগত জীবনে একজন চিকিৎসক।তাঁর গ্রামের বাড়ি বােয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে ।তাঁর পিতা ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অচিন্ত্য কুমার বড়ুয়া।

তিনি চট্টগ্রামের কাফকো'র চীফ মেডিকেল অফিসার বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ডক্টরস এসােসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক  ছিলেন।মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী , দুই কন্যা , এক পুত্রসন্তান সহ অসংখ্য আত্মীয় - স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে যান ।  মৃত্যুর পুর্বে তাঁর দেহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গবেষণাগারে দান করে গেছেন । প্রয়াতের অনিত্যসভা বিকেল ৪ টায় চট্টগ্রাম নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহারে অনুষ্ঠিত হবে । অনিত্যসভা শেষে তাঁর মরদেহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হস্তান্তর করা হবে ।

শনিবার, ৫ জুন, ২০২১

"সীবলি সংসদ" চট্টগ্রামের ত্রি-বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত

"সীবলি সংসদ" চট্টগ্রামের ত্রি-বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত


 

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘‘সীবলী সংসদ” চট্টগ্রামের ত্রি-বাষিক সাধারণ সভা ৪ঠা জুন বিকেলে নগরীর জামালখানস্থ বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে বিকাশ কান্তি বড়ুয়া’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উদ্বোধনী বক্তব্য দেন চারুলতা নিউজ পোর্টাল (সিএনপি) এর মডারেটর লেখক-সাংবাদিক  বিপ্লব বড়ুয়া।  সাধারণ সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি বড়ুয়া, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি যুব এর সাধারণ সম্পাদক স্বপন কুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ বৌদ্ধ যুব পরিষদ চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি সজীব বড়ুয়া ডায়মন্ড ও বুদ্ধজ্যোতি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশ চাপ্টারের পরিচালক বিজয় বড়ুয়া। শাওন বড়ুয়া’র সঞ্চালনায় সভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- সিনিয়র সহ-সভাপতি রণেশ চৌধুরী নন্তু, সুদীপ বড়ুয়া, সুজিত বড়ুয়া, ইমন বড়ুয়া, রুবেল বড়ুয়া, রাকেশ বড়ুয়া, প্রান্তিক বড়ুয়া, সৌরভ চৌধুরী প্রমুখ।



সাধারণ সভায় ২০২১-২০২৪ মেয়াদের ৩১ সদস্য বিশিষ্ট সীবলী সংসদ চট্টগ্রামের নবনির্বাচিত কমিটির পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন বিকাশ কান্তি বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সৌরভ চৌধুরী। নবনির্বাচিত কার্যকরি কমিটির নেতৃবৃন্দরা হলেন- সিনিয়র সহ-সভাপতি রণেশ চৌধুরী নন্তু, সহ-সভাপতি মি. বিপ্লব বড়ুয়া,  মি. সুজিত বড়ুয়া, ইমন বড়ুয়া,  রিপন বড়ুয়া । সাধারণ সম্পাদক সৌরভ চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পিকু বড়ুয়া, সহসাধারণ সম্পাদক শুভময় বড়ুয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক রুবেল বড়ুয়া, সহসাংগঠনিক সম্পাদক শান্তনু বড়ুয়া ও দোলন বড়ুয়া, অর্থ সম্পাদক রাকেশ বড়ুয়া, সহঅর্থ সম্পাদক প্রবাল বড়ুয়া, দপ্তর সম্পাদক শাওন বড়ুয়া, সহদপ্তর সম্পাদক দীপ্র বড়য়া, পরিকল্পনা সম্পাদক প্রান্তিক বড়ুয়া, সহপরিকল্পনা সম্পাদক মিলশন বড়ুয়া, প্রচার সম্পাদক অপু বড়ুয়া, সহপ্রচার সম্পাদক বিজয় বড়ুয়া,হিসাব নিরীক্ষণ সম্পাদক সঞ্চয় বড়ুয়া, সাংস্কৃতিক সম্পাদক ধ্রুব বড়ুয়া, মহিলা সম্পাদিকা বর্ণমালা বড়ুয়া, প্রকাশনা সম্পাদক মুন্না বড়ুয়া, সহপ্রকাশনা সম্পাদক অপরুপ বড়ুয়া, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক অতনু বড়ুয়া, ধর্মীয় সম্পাদক বিমলানন্দ ভিক্ষু, সমাজকল্যান সম্পাদক টিটু বড়ুয়া। কার্যনির্বাহী সদস্য- সুদীপ বড়ুয়া, সৌরভ বড়ুয়া, তপু বড়ুয়া রবি। ।

শুক্রবার, ২১ মে, ২০২১

সরকারি কমার্স কলেজের নতুন অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক সুসেন কুমার বড়ুয়া

সরকারি কমার্স কলেজের নতুন অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক সুসেন কুমার বড়ুয়া

 


সরকারি কমার্স কলেজের নতুন অধ্যক্ষ সুসেন কুমার বড়ুয়া।বৃহস্পতিবার (২০ মে) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে তাঁকে নিয়োগ দেয়া হয়।

অধ্যাপক সুসেন কুমার বড়ুয়ার জন্ম গ্রহন করেন কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার রত্নাপালং গ্রামে।

অধ্যাপক সুসেন কুমার বড়ুয়া ১৯৯৩ সালে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে শিক্ষকতা জীবনের সূচনা করেন খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে। ১৯৯৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বোয়ালখালী কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করে শিক্ষকতা শুরু করেন রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে। 

পরে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ থেকে ২০১৫ সালে আসেন চট্টগ্রাম সরকারি কর্মাস কলেজে হিসাব বিজ্ঞান সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান। এভাবে প্রায় দীর্ঘ সাতাশ বছর শিক্ষার্থীদের পাঠদান করে শিক্ষকতা জীবন অতিবাহিত করেন সুসেন কুমার বড়ুয়া। গত বছরের ৩০ জুলাই অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান তিনি।

শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

পুজনীয় উ. সুমনশ্রী থেরো (অরণ্য ভান্তে) এর সংক্ষিপ্ত জীবন পঞ্জি

পুজনীয় উ. সুমনশ্রী থেরো (অরণ্য ভান্তে) এর সংক্ষিপ্ত জীবন পঞ্জি


জন্ম ও শৈশব কাল : - রাউজান উপজেলার বৌদ্ধ অধ্যুষিত গ্রাম বিনাজুরীতে সুনীল বড়ুয়ার ওরশজাত মায়া বড়ুয়ার কোল জুড়ে শুভ ক্ষনে শুভলগ্নে ধরাধামে আসে ২য় পুত্র সন্তান। সেদিন ছিল ১ জুন ১৯৮৪ সাল শুক্রবার। চারিদিকে খুশীর জোয়ার, বাড়ির বয়স্ক মাতৃমন্ডলী উলু ধ্বনী দিয়ে জয় জয় রব শোনালো সমস্বরে। বাবা-মা আদর করে জয় বলে ডাকতে শুরু করল। শুভদিন ঠিক করে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন উৎসব করে নাম রাখল সবুজ বড়ুয়া।

১৯৯১ সালে সুনীল বড়ুয়া জীবন জীবিকার তাগিদে পরিবার পরিজন নিয়ে আদি নিবাস বিনাজুরী ছেড়ে একেবারে চলে আসেন রাঙ্গুনিয়া শুকবিলাস গ্রামে। শুকবিলাসে তিনি বসতবাড়ি গড়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। সুনীল বড়ুয়ার দুই পুত্র সন্তানের মধ্যে সবুজ বড়ুয়া ছোট। তিনি দুইজনকে শুকবিলাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে জয় তথা সবুজ বড়ুয়া ১ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে। ১৯৯২ সালে চলে যায় বেতাগী অনাথ আশ্রমে। আশ্রমে থাকাকালীন সময়ে ভর্তি হন বেতাগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । এই বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে আশ্রম ছেড়ে চলে যায় পূর্ব আধাঁরমানিক শ্রদ্ধানন্দ বিহারে, ভর্তি হন আধাঁরমানিক নতুন বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে।

প্রবজ্যা : - সবুজ বড়ুয়া জয় এতোদিন পর্যন্ত অনুধাবন করল যে, সংসার দুঃখময় বর্জ্যে পরিপূর্ন। তাই বিবিধ সাংসারিক উপদ্রববিহীন অনাগরিক জীবন লাভের ব্রতী হয়ে বুদ্ধ শাসনে অনুপ্রবেশের জন্য দুঃখকে জয় করার প্রত্যয়ে ১৯৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার শুভদিনে ১২ বছর বয়সে প্রবজ্যিত হয়ে সুমনশ্রী শ্রমন নাম রাখা হল।

উপসম্পদা : - সুমনশ্রী শ্রামণ বুদ্ধের দর্শনকে পরিপূর্ণভাবে জানার মানসে শীল সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলনের জন্য ২৭ অক্টোবর ২০০৫ সালে এক মহালগ্নে উপসম্পদা লাভ করেন।

প্রাতিষ্টানিক শিক্ষালাভ : - শ্রমণ অবস্থায় আধাঁরমানিক নতুন বাজার উচ্চ বিদ্যালয় হতে এস এস সি এবং কুয়াইশ ডিগ্রী কলেজ থেকে ২০০৬ সালে মানবিক বিভাগ হতে এইচ এস সি কৃতিত্বের সহিত পাশ করেন।

বিদেশ ভ্রমণ :- বুদ্ধের ধর্ম ও বিনয় শিক্ষার জন্য ১১ বার ভারত, ২ বার শ্রীলংকা, ১ বার নেপাল, ২ বার বার্মা এবং ১ বার থাইল্যান্ড প্রভৃতি প্রতিরূপ দেশ ভ্রমণ করেন। বিমুক্তির পথ অন্বেষণে প্রথমবার শ্রীলংকা গুন আর্দানা বিদর্শন ভাবনা সেন্টারে দ্বিতীয়বার বার্মা আন্তর্জাতিক অর্হৎ মাহাসি নিগাহ্ সতিপট্ঠান ভাবনা কেন্দ্রে ধ্যান অনুশীলন করেন।

ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান : - বার্মা ধ্যান সেন্টারে ২০০৫ সালের জুলাই মাসে ত্রিচীবরিক, পিন্ডপাতিক, একাসনিক, কলুপৎসাত ও শয়নাসন ইত্যাদি বিষয়ে অধিষ্ঠান রত ছিলেন এবং ওখানে কিছুদিন অবস্থান করেন।

শশ্মানিক অধিষ্ঠান : - দীর্ঘদিন বার্মা ধ্যান সমাধি অনুশীলন করে চরণদ্বীপ জ্ঞানাঙ্কুর বিহারে ফিরে আসেন। চরণদ্বীপ জ্ঞানাঙ্কুর বিহারে অবস্থানকালিন সময়ে ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর আশ্বিনী পূর্ণিমা তিথিতে রাত ১২ টা হইতে কাকডাকা ভোর পর্যন্ত নিরবে নিভৃতে চরণদ্বীপ একটি পারিবারিক শশ্মান ভূমিতে অধিষ্ঠান শুরু করেন। একদিন চরণদ্বীপ গ্রামবাসীর কাছে ভান্তের অধিষ্ঠান প্রকাশ পায়। এরপর থেকে পরিপূর্নভাবে ৬ মাস এই শশ্মানে অবস্থান করেন।

বৌদ্ধ শশ্মান পরিভ্রমণ : - চরণদ্বীপ শশ্মান ভূমি হতে বের হয়ে ২০১৬ সালের ৬ মে বিভিন্ন গ্রামের শশ্মানে বুদ্ধ নির্দেশিত ” বহু জনের হিতের জন্য বহু জনের সুখের জন্য চারিদিক বিচরণ করো ” - এই ব্রত নিয়ে ২০টির অধিক গ্রামে পিন্ডচারণ ও ধর্মদেশনা শুরু করেন। যেমন বোয়ালখালী উপজেলার গোমদন্ডী, চান্দগাঁও, কধুরখীল, শাকপুরা লালার পাড়া, বৈদ্যপাড়া, করলডেঙ্গা, শ্রীপুর, খরণদ্বীপ, জ্যৈষ্ঠপুরা, পটিয়া উপজেলার পাঁচরিয়া, চরকানাই, লাখেরা, পিঙ্গলা, ভান্ডারগাঁও, কর্তালা, তেকোটা, রাউজান উপজেলার পাঁচখাইন, বাগোয়ান, পাহাড়তলী, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেতাগী ধারাবাহিকভাবে অবস্থান করেন।

আরণ্যিক অধিষ্ঠান : - বোয়ালখালী, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও পটিয়া উপজেলার ২০টির অধিক বৌদ্ধ শশ্মানে অধিষ্ঠান করে ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই হতে শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের জ্যৈষ্ঠপুরার গহীন অরণ্যে অদ্যাবধি অধিষ্ঠান রত আছেন। শীল সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলন করে সর্বোপরি নির্বাণ সাধনায় রত থেকে আজীবন অরণ্যে অবস্থান করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহন করেন।


মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২১

বুদ্ধের ভিক্ষুসংঘকে মঙ্গলবিষয়ক সাতটি উপদেশ

বুদ্ধের ভিক্ষুসংঘকে মঙ্গলবিষয়ক সাতটি উপদেশ

 


হে ভিক্ষুগণ, আমি তোমাদের সাতটি মঙ্গলবিধায়ক ধর্মের উপদেশ দেবো, শোনো, উত্তমভাবে মনঃসংযোগ করো।’

১ ৷ হে ভিক্ষুগণ, যতদিন ভিক্ষুগণ নিজেদের সম্মিলনের ব্যবস্থা করে বার বার একত্রিত হবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷
২৷ যতদিন তাঁরা সমগ্র হয়ে একত্রিত হবেন ৷ সমগ্র হয়ে উত্থান করবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

৩৷ যতদিন সমগ্র হয়ে সংঘনির্দিষ্ট কর্মসমূহের সম্পাদন করবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

৪ ৷ যতদিন তাঁরা অব্যবস্থিতের ঘোষণা না করবেন, ব্যবস্থিতের উচ্ছেদ না করবেন, যথাব্যবস্থিত শিক্ষাপদগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

৫ ৷যতদিন তাঁরা তাঁদের মাঝে যাঁরা অভিজ্ঞ, বহুপূর্বগ, সংঘপিতা, সংঘপরিনায়ক, তাঁদের সৎকার করবেন, তাঁদের ভক্তি করবেন, তাঁদের সম্মান ও পূজা করবেন, তাঁদের বাক্য উপদেশ মেনে চলা উচিত বলে মনে করবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷


৬ ৷ যতদিন তাঁরা উৎপন্ন পুনর্জন্মদায়ক তৃষ্ণার বশবর্তী না হয়ে তাঁরা নির্জনবাসে প্রীতিলাভ করবেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

৭ ৷ যতদিন তাঁরা নিজ নিজ চিত্তের সৈ'র্য সম্পাদন করবেন, যাতে অনাগত প্রিয়শীল সব্রহ্মচারীগণ তাঁদের কাছে আসতে পারেন এবং যাঁরা আগত তাঁরা স্বচ্ছন্দে অবস্থান করতে পারেন ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

যতদিন এই সাত মঙ্গলবিধায়ক ধর্ম তাঁদের মাঝে বর্তমান থাকবে, যতদিন তাঁরা ওই ধর্মানুসারে নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করবেন, ততদিন তাঁদের পতন না হয়ে উত্থান হইবে ৷

[©ফেইসবুক থেকে নেওয়া]

রবিবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২১

বৌদ্ধধর্মে দশপ্রকার পুণ্যকর্ম

বৌদ্ধধর্মে দশপ্রকার পুণ্যকর্ম

 

বৌদ্ধধর্মমতে, নির্বাণ লাভ না করা পর্যন্ত সবারই পুণ্যকর্ম করা দরকার। ধর্মপদে বুদ্ধ বলেছেন, কেউ যদি পুণ্যকর্ম করে তাহলে সেটা যেন সে বারবার করে, তা যেন সে সবসময় আকাঙ্খা করে, কারণ পুণ্যসঞ্চয় হচ্ছে সুখদায়ক (ধম্মপদ-১১৮)।

কিন্তু কোন কোন কাজগুলো পুণ্যকর্ম হিসেবে গণ্য হয়? অভিধর্মপিটকের ধর্মসঙ্গণি অর্থকথামতে সেগুলো হচ্ছে দশ প্রকার কাজ, যেমন- দানজনিত পুণ্যকর্ম, শীলজনিত পুণ্যকর্ম, ভাবনাজনিত পুণ্যকর্ম, সম্মান প্রদর্শনজনিত পুণ্যকর্ম, সেবামূলক পুণ্যকর্ম, পুণ্যদানজনিত পুণ্যকর্ম, অনুমোদনমূলক পুণ্যকর্ম, দেশনাজনিত পুণ্যকর্ম, শ্রবণজনিত পুণ্যকর্ম, সম্যকদৃষ্টি গঠনকারী কর্মজনিত পুণ্যকর্ম। এই হচ্ছে দশপ্রকার পুণ্যকর্ম।

দানজনিত পুণ্যকর্ম কী কী? অনেকভাবে দান করা যায়। ভিক্ষুদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন- চীবর, ভিক্ষান্ন, বাসস্থান, ওষুধপত্র ইত্যাদি ভিক্ষুসঙ্ঘকে দান করা যায়। অাবার রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ অথবা মানসিক বিষয়মূলক যেকোনোকিছু দান করা যায়। আবার বৌদ্ধদের চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী দশ প্রকার দানীয় বস্তু রয়েছে, যেমন- অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, যানবাহন, মালা, সুগন্ধি, প্রলেপন, শয্যা বা বিছানা, আবাস, প্রদীপ। সেগুলোও দান করা যায়। দান করার উদ্দেশ্যে এসমস্ত জিনিস সংগ্রহ করার সময়ে যেসমস্ত কুশল চেতনা উৎপন্ন হয় সেগুলো সবই হচ্ছে দানজনিত পুণ্যকর্ম।

দানের আগে, দানের সময়ে এবং দানের পরে খুশিমনে স্মরণকালেও যেসমস্ত কুশল চেতনা উৎপন্ন হয় সেগুলো সবই হচ্ছে দানজনিত পুণ্যকর্ম। এভাবে একটা দানানুষ্ঠানের মাধ্যমে যে কত অসংখ্য কুশল চেতনা উৎপন্ন হয় তার সীমা নেই। সেগুলোর কিছু ইহজন্মেই ফল দেয়, কিছু পরবর্তী জন্মে ফল দেয়, বাকিগুলো পরিনির্বাপিত না হওয়া পর্যন্ত যেখানেই সুযোগ পায় সেখানেই ফল দিয়ে থাকে। কাজেই যেকোনো দান অনুষ্ঠানের আগে ও পরে সবসময় খেয়াল রাখবেন যেন কুশল চেতনা বজায় থাকে।

দানের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধভাবে দান করাও গুরুত্বপূর্ণ। তার জন্য চারটি বিষয় থাকতে হয়- ন্যায্য দ্রব্যসামগ্রী, মহাচেতনা, ক্ষেত্রসম্পত্তি, অতিরিক্ত গুণ। দাতার দ্রব্যসামগ্রী যদি ধর্মত ও ন্যায্যভাবে প্রাপ্ত হয় তা হয় ধর্মসঙ্গত। দাতা যদি দানের ফল আছে বলে বিশ্বাস করে শ্রদ্ধাভরে দান দেয় তাহলে সেটা হয় তার মহাচেতনা। অন্যদিকে গ্রহীতা যদি আসবহীন অর্হৎ হয় তা হয় ক্ষেত্রসম্পত্তি। আবার গ্রহীতা যদি অর্হৎ হয় এবং নিরোধধ্যান থেকে উঠে যায়, তখন সেই অবস্থার নাম হয় অতিরিক্ত গুণ। এই চারটি গুণের সম্মিলন করে দান করতে সক্ষম হলে সেই কামাবচর কুশল পুণ্যকর্ম খুবই শক্তিশালী হয় এবং ইহজন্মেই ফল দেয়। পুণ্ণক শ্রেষ্ঠী, কাকবলি, সুমন মালাকার ইত্যাদিরাও এভাবে ইহজন্মেই ফল পেয়েছিল।

গৃহীদের পঞ্চশীল, অষ্টশীল ও দশশীল গ্রহণ ও শীল রক্ষার সময়ে চলমান চেতনাগুলো হচ্ছে শীলময় পুণ্যকর্ম। প্রব্রজিতদের প্রব্রজ্যা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ‘প্রব্রজিত হবো’ এই মন নিয়ে বিহারে গমনের সময়ে, প্রব্রজ্যার সময়ে, ‘মনস্কামনা পূর্ণ হলো, আমি এখন প্রব্রজিত, সাধু সাধু’ এভাবে নিজের প্রব্রজ্যা পর্যালোচনার সময়ে, পাতিমোক্ষ শীলে সংযত থাকার সময়ে, চীবর ইত্যাদি জিনিস ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রত্যবেক্ষণ বা পর্যালোচনার সময়ে, দৃষ্টিপথে রূপ ইত্যাদি আসলেও চোখ, কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গুলো সংযত রাখার সময়ে, এবং জীবিকা পরিশুদ্ধ করার সময়ে চলমান চেতনাগুলো হচ্ছে শীলময় পুণ্যকর্ম।

প্রতিসম্ভিদায় উল্লেখিত বিদর্শনপদ্ধতিতে চোখকে অনিত্য হিসেবে, দুঃখ হিসেবে, অনাত্ম হিসেবে ভাবনাকালে … মনকে … রূপগুলোকে … ধর্ম বা বিষয়গুলোকে … চোখবিজ্ঞানকে … মনোবিজ্ঞানকে … চোখসংস্পর্শকে … মনসংস্পর্শকে … চোখসংস্পর্শ থেকে উৎপন্ন বেদনাকে … মনসংস্পর্শ থেকে উৎপন্ন বেদনাকে … রূপসংজ্ঞাকে … জরামরণকে অনিত্য হিসেবে, দুঃখ হিসেবে, অনাত্ম হিসেবে ভাবনাকালে চলতে থাকা চেতনাগুলো, অথবা আটত্রিশ প্রকার ধ্যানের যেকোনোটাতে মনটা একাগ্র না হওয়া পর্যন্ত সবগুলো চেতনা হচ্ছে ভাবনাময় পুণ্যকর্ম।

গৃহীদের ক্ষেত্রে পিতামাতা, শিক্ষক, ভিক্ষু-শ্রামণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠদেরকে অভিবাদন করা, সসম্মানে পথ ছেড়ে দেয়া, ইত্যাদি নানাপ্রকারে যথাযোগ্য ব্যক্তিদেরকে সম্মান প্রদর্শন হচ্ছে সম্মানপ্রদর্শন সংশ্লিষ্ট পুণ্যকর্ম। ভিক্ষুদের ক্ষেত্রে সিনিয়র ভিক্ষুদেরকে দেখে এগিয়ে গিয়ে তাদের পাত্রচীবর গ্রহণ করা, অভিবাদন করা, সসম্মানে পথ ছেড়ে দেয়া ইত্যাদিকে সম্মানপ্রদর্শন সংশ্লিষ্ট পুণ্যকর্ম বলে বুঝতে হবে।

গৃহীদের ক্ষেত্রে পিতামাতা, শিক্ষক, ভিক্ষু-শ্রামণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের নানা কাজ করে দেয়া, রোগীর সেবা করা ইত্যাদি সেবামূলক কাজগুলো হচ্ছে সেবাসংশ্লিষ্ট পুণ্যকর্ম। ভিক্ষুদের ক্ষেত্রে সিনিয়র ভিক্ষুদের প্রতি করণীয় ব্রত ও অন্যান্য কায়িক সেবা প্রদানকালে চলতে থাকা চেতনাগুলো সেবাসংশ্লিষ্ট পুণ্যকর্ম বলে বুঝতে হবে।

দান দিয়ে, সুগন্ধি ইত্যাদি দ্বারা পূজা করে ‘অমুকের পুণ্য হোক’ অথবা ‘এই পুণ্য সকল সত্ত্বের হোক’ এভাবে পুণ্য দান করাকেই পুণ্যপ্রদানের পুণ্যকর্ম বলে বুঝতে হবে। এভাবে পুণ্য ভাগ দিলে কি পুণ্য ক্ষয় হয়? হয় না। যেমন একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে তা থেকে হাজারো প্রদীপ জ্বালালেও প্রথম প্রদীপকে অনুজ্জ্বল বলা যায় না, বরং তখন প্রথম প্রদীপের আলোর সাথে পরবর্তী প্রদীপগুলোর আলোও একত্রিত হয়ে বিশাল আলো হয়ে ওঠে। এভাবেই পুণ্য বিতরণকালে কোনো ক্ষতি নেই, বরং লাভই হয় বলে বুঝতে হবে।

অন্যের দেয়া পুণ্য অথবা অন্যের কোনো ভালোকাজ বা পুণ্যকাজকে ‘সাধু সাধু’ বলে অনুমোদন বা সমর্থনের মাধ্যমে অনুমোদনের পুণ্যকর্ম হয় বলে বুঝতে হবে।

কেউ কেউ ‘এভাবে আমাকে সবাই ধর্মীয় বক্তা হিসেবে জানবে’ এই ইচ্ছায় লাভপ্রত্যাশী হয়ে ধর্মদেশনা করে, তা মহাফলদায়ক হয় না। কেউ কেউ কোনো প্রত্যাশা না করে বিমুক্তিকে মাথায় রেখেই নিজের সুপরিচিত ধর্মকে অন্যের কাছে দেশনা করে, সেটাই হচ্ছে দেশনাময় পুণ্যকর্ম।

কেউ কেউ দেশনা শুনতে শুনতে ‘এভাবে আমাকে সবাই শ্রদ্ধাবান বলে জানবে’ মনে এমন ভাব নিয়ে দেশনা শোনে, তা মহাফলদায়ক হয় না। কেউ কেউ ‘এভাবে আমার মহাফল লাভ হবে’ এভাবে মঙ্গলাকাঙ্খী হয়ে মৃদু কোমল চিত্ত নিয়ে ধর্মদেশনা শোনে, সেটাই হচ্ছে শ্রবণময় পুণ্যকর্ম।

অনেকেরই বিভিন্ন ধরনের ভুল ধারণা থাকে। যেমন কেউ কেউ দানের ফল বিশ্বাস করে না। স্বর্গনরক আছে বলে বিশ্বাস করে না। অদৃশ্য দেবতা আছে বলে বিশ্বাস করে না। বিভিন্ন ধরনের ভুল ধারণা পোষণ করে। বিভিন্ন বই পড়ে, দেশনা শুনে, ভাবনা করে অথবা আলোচনার মাধ্যমে এসব ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করার কাজে রত থাকলে তা হয় ‘দৃষ্টিভঙ্গি ঋজুকারী কর্মের পুণ্যকর্ম’।

এই পুণ্যকর্মগুলোর মধ্যে ‘দান দেব’ বলে চিন্তা করার সময়ে দানময় পুণ্যকর্ম উৎপন্ন হয়, দান দেয়ার সময়ে এবং ‘দান দিয়েছি’ বলে পর্যালোচনা করার সময়েও দানময় পুণ্যকর্ম উৎপন্ন হয়। এভাবে পূর্ববর্তী চেতনা, ত্যাগকালীন চেতনা এবং পরবর্তী চেতনা, এই তিন প্রকার চেতনাকে একত্রে ‘দানময় পুণ্যকর্ম’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। শীলময় পুণ্যকর্মও ‘শীল পূরণ করব’ চিন্তা করার সময়ে উৎপন্ন হয়, শীল পূরণকালে উৎপন্ন হয়, ‘আমার শীল পূরণ হয়েছে’ এভাবে পর্যালোচনাকালে উৎপন্ন হয়। সেগুলো সব একত্র করে ‘শীলময় পূণ্যকর্ম’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। … দৃষ্টিভঙ্গি ঋজুকারী পুণ্যকর্মও ‘দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করব’ এমন চিন্তা করার সময়ে উৎপন্ন হয়, দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করার সময়ে উৎপন্ন হয়, ‘আমি দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করেছি’ এমন পর্যালোচনাকালে উৎপন্ন হয়। সেগুলো সব একত্র করে ‘দৃষ্টিভঙ্গি ঋজুকারী পুণ্যকর্ম’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

সুত্রে কিন্তু কেবল দান, শীল ও ভাবনা – এই তিন প্রকার পুণ্যকাজের কথা বলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বাদবাকি পুণ্যকর্মও অন্তর্ভুক্ত বলে বুঝতে হবে। সম্মান প্রদর্শন ও সেবার কর্মগুলো শীলময় পুণ্যকাজের অন্তর্গত হয়। পুণ্যদান, পুণ্য অনুমোদনের কর্মগুলো দানময় পুণ্যকাজের অন্তর্গত হয়। ধর্মদেশনা করা, ধর্মদেশনা শ্রবণ, সম্যকদৃষ্টি গঠনকারী কর্মগুলো ভাবনাময় পুণ্যকাজের অন্তর্গত হয়। এভাবে এগুলো সংক্ষেপে তিনটি হলেও বিস্তারিতভাবে বললে দশটি পুণ্যকর্ম হয়।

আবার এই স্থানে ছয় প্রকার পুণ্যসঞ্চয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পুণ্য স্বয়ংকৃত অাছে, পরকৃত আছে, স্বহস্তকৃত আছে, আদিষ্ট আছে, সম্প্রজ্ঞানেকৃত আছে, অসম্প্রজ্ঞানেকৃতও আছে।

এগুলোর মধ্যে নিজের স্বভাববশত পুণ্য করলে সেটা হয় স্বয়ংকৃত। অন্যকে করতে দেখে করলে হয় পরকৃত। নিজ হাতে পুণ্য করলে হয় স্বহস্তেকৃত। আদেশ দিয়ে করালে সেটা হয় আদিষ্ট। কর্ম ও ফলের প্রতি বিশ্বাস রেখে পুণ্য করলে হয় সম্প্রজ্ঞানেকৃত । কর্ম ও ফলকে না জেনে করলে হয় অসম্প্রজ্ঞানেকৃত। এসব পুণ্যকর্ম করার সময়ে আটটি কুশল চিত্তের কোনো একটি চিত্ত দ্বারা করা হয়ে থাকে।

পুণ্যকর্মের ব্যাপারে তো জানলেন। এবার নিজের অবস্থা একটু চিন্তা করুন। বর্তমানে মানুষ বাঁচে বড় জোর ৭০-৮০ বছর। আর কত বছর বাঁচবেন আপনি হিসেব করুন তো। এবার একটু মন দিয়ে চিন্তা করুন- জীবনের যে বছরগুলো ফেলে এসেছেন সেগুলোতে কি যথেষ্ট পুণ্য সঞ্চয় হয়েছে? আগামী যে কয়টা বছর বাঁচবেন সেগুলো কি পুণ্যসঞ্চয়ের পরিকল্পনা করেছেন কি? আপনার দৈনন্দিন জীবনে উপরোক্ত পুণ্যকাজগুলো করা হচ্ছে তো? প্রতিদিন যাতে অন্তত উপরোক্ত যেকোনো একটি পুণ্যকাজ হয় সেভাবে একটা পরিকল্পনা করুন। এখনি শুরু করে দিন। শুভকাজে দেরি করতে নেই।

Gansanta.org থেকে নেওয়া

শুক্রবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২১

গৌতম বুদ্ধের আলোচিত উক্তিসমূহ

গৌতম বুদ্ধের আলোচিত উক্তিসমূহ




১। অতীতকে প্রাধান্য দিও না, ভবিষ্যত নিয়ে দিবাস্বপ্নও দেখবে না। তার চেয়ে বরং বর্তমান মুহূর্ত নিয়ে ভাবো।

 ২। সবকিছুর জন্য মনই আসল। সবার আগে মনকে উপযুক্ত করো, চিন্তাশীল হও। আগে ভাবো তুমি কী হতে চাও।

 ৩। আনন্দ হলো বিশুদ্ধ মনের সহচর। বিশুদ্ধ চিন্তাগুলো খুঁজে খুঁজে আলাদা করতে হবে। তাহলে সুখের দিশা তুমি পাবেই।

 ৪। তুমিই কেবল তোমার রক্ষাকর্তা, অন্য কেউ নয়। 

 ৫। জীবনের প্রথমেই ভুল হওয়া মানেই এই নয় এটিই সবচেয়ে বড় ভুল। এর থেকে শিক্ষা নিয়েই এগিয়ে যাও।

 ৬। অনিয়ন্ত্রিত মন মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে। মনকে প্রশিক্ষিত করতে পারলে চিন্তাগুলোও তোমার দাসত্ব মেনে নেবে। 

 ৭। তোমাদের সবাইকে সদয়, জ্ঞানী ও সঠিক মনের অধিকারী হতে হবে। যতই বিশুদ্ধ জীবনযাপন করবে, ততাই উপভোগ করতে পারবে জীবনকে।

 ৮। আমরা অনেকেই একটা কিছুর সন্ধানে পুরো জীবন কাটিয়ে দেই। কিন্তু তুমি যা চাও তা হয়তো এরইমধ্যে পেয়েছ। সুতরাং, এবার থামো। 

 ৯। সুখের জন্ম হয় মনের গভীরে। এটি কখনও  বাইরের কোনো উৎস থেকে আসে না। 

 ১০। অন্যের জন্য ভালো কিছু করতে পারাটাও তোমার জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। 

 ১১। জীবনের খুব কম মানুষের জীবনে পরিপক্কতা আসে। সঙ্গী হিসেবে এই পরিপক্কতাকে তোমার অর্জন করতে হবে। তবে তা ভুল মানুষকে অনুসরণ করে নয়। এই পরিপক্কতা অর্জনে বরং একলা চলো নীতি অনুসরণ করো। 

 ১২। করুণাই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি। 

 ১৩। সুখ কখনও আবিষ্কার করা যায় না। এটি সবসময় তোমার কাছে আছে এবং থাকবে। তোমাকে কেবল দেখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। 

 ১৪। রেগে যাওয়া মানে নিজেকেই শাস্তি দেওয়া।  

 ১৫। সত্যিকারভাবে ক্ষমতা নিয়ে বাঁচতে হলে নির্ভয়ে বাঁচো।


১৬। জীবনে ব্যাথা থাকবেই, কিন্তু কষ্টকেই ভালোবাসতে শেখো।

 ১৭। অনেক মোমবাতি জ্বালাতে আমরা কেবল একটি মোমবাতিই ব্যবহার করি। এর জন্য ওই মোমবাতিটির আলো মোটেও কমে না। সুখের বিষয়টিও এমনই।  

 ১৮। যখন আমরা মনের রূপান্তর ঘটাই, আর চিন্তাগুলো বিশুদ্ধ করি, তখন আমরা অন্যায় কাজ থেকে জীবনকে পরিশুদ্ধ করি। এর মাধ্যমে খারাপ কাজের চিহ্নও মুঁছে যায়। 

১৯। অন্যকে কখনও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করো না, নিয়ন্ত্রণ করো কেবল নিজেকে। 

 ২০। আলোকিত হতে চাইলে প্রথমে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করো। 

 ২১। জ্ঞানগর্ভ জীবনের জন্য মুহূর্তের ইতিবাচক  ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে। এই জন্য ভয়কে তুচ্ছ করতে হবে, এমনকি মৃত্যুকেও। 

 ২২। এই তিনটি সর্বদা দেখা দেবেই: চাঁদ, সূর্য এবং সত্য।

 ২৩। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তের সমন্বয়ই জীবন। কেবল একটি সঠিক মুহূর্ত পাল্টে দেয় একটি দিন। একটি সঠিক দিন পাল্টে দেয় একটি জীবন। আর একটি জীবন পাল্টে দেয় গোটা বিশ্ব। 

২৪। নিজের কথার মূল্য দিতে হবে নিজেকেই। কেননা, তোমার নিজের কথার ওপর নির্ভর করবে অন্যের ভালো কাজ কিংবা মন্দ কাজ। 

 ২৫। ঘৃণায় কখনও ঘৃণা দূর হয় না। অন্ধকারে আলো আনতে তোমাকে কোনো কিছুতে আগুন জ্বালতেই  হবে। 

 ২৬। শুভর সূচনা করতে প্রত্যেক নতুন সকালই তোমার জন্য এক একটি সুযোগ।

 ২৭। আমরা প্রত্যেকেই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। একজন আরেকজনের পরিপূরক। অর্থাৎ সমাজে আমরা কেউ একা নই। 

 ২৮। খারাপটি সর্বদা তুমি নিজেই পছন্দ করছো। সুতরাং, তোমার খারাপ কাজের জন্য তুমি নিজেই দায়ী। এর দায়ভার অন্য কারো নয়।। 

২৯। তোমার চিন্তাই তোমার শক্তির উৎস। নেতিবাচক চিন্তা তোমাকে অনেক বেশি আঘাত করে যা তোমার ধারণায় নেই। 

৩০। নির্বোধ বন্ধু আদৌ কোনো বন্ধু নয়। নির্বোধ বন্ধু থাকার চেয়ে একা হওয়া অনেক ভালো। 

শনিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২১

মহামানব গৌতম বুদ্ধ (পর্ব২)দীপংকর বুদ্ধের সাক্ষাৎ

মহামানব গৌতম বুদ্ধ (পর্ব২)দীপংকর বুদ্ধের সাক্ষাৎ

 



এভাবে সুমেধ তাপস অভিজ্ঞাশক্তি অর্জন করে হিমালয়ে সমাপত্তিসুখে অবস্থানকালে জগতে দীপংকর নামে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর মায়ের গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ, জন্ম, সম্বোধিলাভ ও ধর্মচক্র প্রবর্তনের সময় দশ হাজার চক্রবাল কম্পিত, প্রকম্পিত ও আন্দোলিত হয়ে মহাশব্দে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এবং বত্রিশ প্রকার পূর্বনিমিত্ত দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সুমেধ তাপস গভীর সমাপত্তিধ্যানে মগ্ন থাকায় সেই মহাশব্দ শোনেননি, আর সেসব নিমিত্তও (লক্ষণ) দেখেননি।

সে সময় দীপংকর বুদ্ধ চার লক্ষ আস্রবহীন শিষ্যসহ বিচরণ করতে করতে ‘রম্যক’ নামক নগরের উপকণ্ঠে সুদর্শন মহাবিহারে অবস্থান করছিলেন। রম্যনগরবাসীগণ শুনল যে, শ্রমণশ্রেষ্ঠ দীপংকর পরম সম্বোধি লাভ করে ধর্মচক্র প্রবর্তনের পর ক্রমান্বয়ে ভ্রমণ করতে করতে তাদেরই নগরের কাছে সুদর্শন মহাবিহারে বাস করছেন। এই খবর শুনে তারা তখন ঘি, মাখনাদি ওষুধ এবং সুন্দর আচ্ছাদন, সুগন্ধি দ্রব্য, ফুল-বাতি ইত্যাদি যাবতীয় পূজার সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে প্রগাঢ় শ্রদ্ধাসহকারে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘমনা হয়ে বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হলো এবং বন্দনা ও পূজার সামগ্রীগুলো নিয়ে পূজা করে সবাই একপাশে বসল। বুদ্ধ তাদের ধর্মোপদেশ দানে তৃপ্ত করলে সবাই আসন হতে উঠে বুদ্ধকে আগামী পরদিনের জন্য নিমন্ত্রণ করে নিজ গ্রামে চলে গেল।

পরদিন সেখানকার সব নাগরিক এক মহাদানযজ্ঞের আয়োজন করে নগরীকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে তথাগতের আগমন-পথ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করল। বর্ষাকালীন জলস্রোতে রাস্তার ভাঙা অংশ এবং অসমতল কিংবা কাদাময় স্থানগুলো নতুন মাটি দিয়ে সমতল করে তাতে সাদা রঙের বালু ছিটাতে লাগল। তার ওপর লাজ-ফুল ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন কাপড়ের ধ্বজাপতাকা উত্তোলন করল। এ ছাড়াও স্থানে স্থানে কলাগাছ রোপণ ও মঙ্গলঘট স্থাপন করল। সে সময় সুমেধ তাপস আশ্রম হতে বের হয়ে আকাশপথে যাবার সময় নিচে কর্মব্যস্ত উল্লসিত জনতাকে দেখে শিগগিরই আকাশ হতে অবতরণ করে জনগণকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘বন্ধুগণ, কোন ভাগ্যবান পুরুষের আগমন উপলক্ষে তোমাদের এই বিরাট আয়োজন?’

প্রত্যুত্তরে লোকজন তাঁকে বলল, ‘প্রভু সুমেধ, আপনি কি জানেন না যে দীপংকর বুদ্ধ সম্যক সম্বোধি লাভ করে ধর্মচক্র প্রবর্তন করেছেন? সম্প্রতি তিনি দেশ পর্যটন করতে করতে আমাদের নগরসীমায় সুদর্শন মহাবিহারে বাস করছেন। আজ আমরা তাঁকে নিমন্ত্রণ করেছি। তাঁর আগমন উপলক্ষেই রাস্তাঘাট সংস্কার ও সাজানো হচ্ছে।’ এই কথা শুনে তাপস ভাবলেন, “বুদ্ধ উৎপন্নের কথা দূরে থাকুক, ‘বুদ্ধ’ এই শব্দ শোনাও জগতে অতি দুর্লভ। সুতরাং এই জনগণের সঙ্গে সংস্কারকাজে আমারও অংশগ্রহণ করা অবশ্যকর্তব্য।” এই চিন্তা করে তিনি জনগণকে অনুরোধ করে বললেন, ‘মহাশয়গণ, আপনারা যদি সম্যকসম্বুদ্ধের আগমন উপলক্ষেই এই সংস্কারকাজে আত্মনিয়োগ করে থাকেন, তা হলে অনুগ্রহ করে আমাকেও সেই পুণ্যের একজন অংশীদার করুন। আপনাদের সঙ্গে আমিও এই সংস্কারকাজে আত্মনিয়োগ করব।’

তারা আনন্দসহকারে সেই প্রস্তাবে সম্মত হলো। তারা জানত যে, এই সুমেধ তাপস হচ্ছেন মহা অলৌকিক শক্তিধর। তাই তারা তাঁকে এক কাদাযুক্ত স্থান দেখিয়ে বলল, ‘ভন্তে, আপনি এখানটি সমতল করে সুন্দরভাবে সাজান।’ সুমেধ তাপস ‘বুদ্ধ’ ‘বুদ্ধ’ বলে বুদ্ধকে উপলক্ষ করে প্রীতি উৎপন্ন করে ভাবলেন, আমি ইচ্ছা করলে রাস্তার এই ভাঙা-অংশটুকু আমার অলৌকিক শক্তিবলে অল্প সময়ে অনায়াসে সংস্কার করতে পারি। কিন্তু তাতে আমি তৃপ্ত হব না। বরং আজ আমি কায়িক শ্রমের দ্বারা কাজটি সম্পন্ন করে বুদ্ধের সেবা করব। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি নিজ হাতে মাটি আহরণ করে সেই অংশটি সংস্কার করতে লাগলেন। কিন্তু তাঁর কাজ শেষ হবার আগেই মারজিৎ দীপংকর মহামুনি ষড়ভিজ্ঞ, সমদর্শী এবং বিগতমল চার লক্ষ ক্ষীণাস্রব শিষ্যসহকারে রাস্তায় পৌঁছে গেলেন। দেবমনুষ্যগণ আমোদিত হয়ে তাঁকে আগু বাড়িয়ে নিল এবং নানাপ্রকার ভেরিনিনাদে গগনমণ্ডল মুখরিত করে সাধুবাদ দিতে লাগল।

তখন দেবতারা মানুষদের আর মানুষেরা দেবতাদের দেখতে পাচ্ছিল। তারা উভয় পক্ষই করজোড়ে তথাগত বুদ্ধের অনুগমন করছিল। দেবগণ দিব্য তূর্যধ্বনি আর মানুষেরা মানুষিক তূর্যধ্বনি করতে করতে মহামুনি দীপংকর বুদ্ধের অনুগমন করছিল। দেবতারা আকাশ থেকে দিব্য মন্দার ফুল, পদ্ম ফুল ও পারিজাত ফুল চারদিকে ছিটিয়ে দিচ্ছিল। মানুষেরা পৃথিবী থেকে চম্পক, কুসুম, কদম, নাগেশ্বর, পুন্নাগ, কেতকী ও পদ্ম শাপলা ইত্যাদি ফুল ওপরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছিল।

এমতাবস্থায় সুমেধ তাপস অনন্যোপায় হয়ে নিজের হিত চিন্তা করে মনে মনে বললেন, ‘বুদ্ধের জন্য প্রয়োজনে আমি নিজের জীবনও বিলিয়ে দিতে পারি। তাই তিনি যাতে কাদায় না পড়েন, সেই ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে। আমি কাদায় শুয়ে পড়ব, আর চার লক্ষ আস্রবহীন অর্হৎসহ বুদ্ধ আমার পিঠের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবেন। এতে করে আমার ভাবী মঙ্গল হবে।’ এই ভেবে তিনি তাতে সেতুর মতো করে শুয়ে পড়লেন।

তিনি শায়িত অবস্থায় বুদ্ধের অপূর্ব বুদ্ধশ্রী অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে ভাবতে লাগলেন, ‘এখন আমি ইচ্ছা করলেই সব ক্লেশগুলো ধ্বংস করে সংঘভুক্ত হয়ে এদের সঙ্গেই রম্যনগরে প্রবেশ করতে পারি। কিন্তু জনসাধারণের অজ্ঞাতসারে চার আর্যসত্য ধর্মকে প্রত্যক্ষ করে আমি তৃপ্তি লাভ করতে পারব না। বরং আমি দীপংকর বুদ্ধের মতো সর্বজ্ঞতা লাভ করে অসংখ্য দেবমানবকে ধর্মনৌকায় তুলে নিয়ে ভবদুঃখ থেকে ত্রাণ করব। পুরুষোত্তম দীপংকর বুদ্ধের কাছে কৃত আমার এই শ্রেষ্ঠ কর্মের বিপাকে সর্বজ্ঞতা লাভ করে অসংখ্য প্রাণীকে মুক্ত করব। সংসারস্রোত ছিন্ন করে এবং কাম, রূপ ও অরূপ, এই ত্রিভবের কর্মক্লেশ ধ্বংস করে আর্য-অষ্টাঙ্গিক-মার্গরূপ ধর্মনৌকায় তুলে দেবমনুষ্যগণকে মুক্ত করব।’—অপদান অর্থকথা

বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২১

অবিদ্যা হতে যাবতীয় দুঃখের সৃষ্টি(আর্যশ্রাবক বনভন্তে)

অবিদ্যা হতে যাবতীয় দুঃখের সৃষ্টি(আর্যশ্রাবক বনভন্তে)

 



আর্যশ্রাবক বনভন্তের ধর্মদেশনা

সংকলক : শ্রীমৎ ইন্দ্রগুপ্ত ভিক্ষু

অবিদ্যা হতে যাবতীয় দুঃখের সৃষ্টি

একসময় বনভন্তে নিজ আবাসিক ভবনে ভিক্ষুসঙ্ঘকে দেশনা প্রদান প্রসঙ্গে বলেন, এ দেহ অসার, মূল্যহীন; দেহে কোনো সার নেই, কোনো মূল্য নেই শুধু অশুচি পদার্থে ভরা। তাই জ্ঞানীজনেরা দেহের প্রতি সর্বদা অনাসক্ত থাকেন। তোমরা দেহের প্রতি মমতা ত্যাগ কর, দেহকে নিয়ে নানাবিধ ভোগের আকাঙ্ক্ষা করিও না। সারহীন, মূল্যহীন দেহে কিসের ভোগ? কিসের আসক্তি? দেহকে অশুচি জ্ঞানে দর্শন করলে দেহের প্রতি আসক্তিভাব উৎপত্তি হয় না। দেহ হতেই নানাবিধ দুঃখ, ভয়ের কারণ উৎপন্ন হয়; দেহকে যত ত্যাগ করা যায় ততই সুখ। যেইজন দেহকে যত ত্যাগ করতে পারছে সেইজন তত বেশি সুখে অবস্থান করতেছে বলে জানবে।

প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি সম্বন্ধে জ্ঞান থাকলে ধর্মের প্রতি সন্দিহানভাব দূর হয় এবং দৃঢ় বিশ্বাস উৎপন্ন হয়। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি সম্বন্ধে অজ্ঞান হলে ধর্মের প্রতি সন্দেহ উৎপন্ন হয়, অবিশ্বাস ভাব জন্মে। চারি আর্যসত্য সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকলে জগতে সুখ খোঁজে বেড়াতে হয়। স্ত্রী-পুত্র, ধন-জন, ভোগ-ঐশ্বর্য নিয়ে সংসারী হয়ে সুখাকাঙ্ক্ষী হয়। কামলোক, রূপলোক, অরূপলোক এই ত্রিলোকে ঘুরে ঘুরে সুখ অন্বেষণ করতে হয়। চারি আর্যসত্য সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ হলে ত্রিলোকের মধ্যে কোনোপ্রকার সুখ অন্বেষণ করে না স্ত্রী-পুত্র, ধন-জন দ্বারা সংসারী হয়ে সংসারে সুখ দেখে না এবং কোথাও সুখ অন্বেষণ করে না। এককথায় সুখের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান হলে সদ্ধর্মে সন্দেহ উদয় হয় না, সংস্কাররাশি উৎপন্ন হয় না। মনচিত্ত কুশল-সংস্কার, অকুশল-সংস্কার, আনেঞ্জা-সংস্কার কোনোপ্রকার সংস্কারে লিপ্ত থাকে না। সংস্কারের অপর নাম হল কর্ম। যেই ভিক্ষুর বিদ্যা উৎপত্তি হয়েছে সেই ভিক্ষু কুশল-সংস্কারও উৎপন্ন করে না, অকুশল-সংস্কারও উৎপন্ন করে না এবং আনেঞ্জা-সংস্কারও উৎপন্ন করে না; তাতেই তিনি পরম সুখে থাকেন। অবিদ্যাকে বিদ্যা উৎপত্তি দ্বারা সম্পূর্ণরূপে নিরোধ করতে পারলে সংস্কাররাশি উৎপন্ন হয় না। সংস্কাররাশি উৎপন্ন না হলে দুঃখরাশিও উৎপন্ন হয় না। এভাবে দুঃখরাশি নিরোধ হলে নির্বাণ সুখ লাভ হয়।

অবিদ্যা হতে যাবতীয় দুঃখরাশির উৎপত্তি, অবিদ্যা না থাকলে দুঃখরাশিও নেই। তাই বলা যায়, দুঃখ কোথা হতে আসতেছে? অবিদ্যা থেকে। দুঃখ কেন ধ্বংস হচ্ছে না? অবিদ্যার কারণে বা হেতুতে। এসব থেকে প্রমাণ মিলে যে, অবিদ্যা হতেই দুঃখ উদয় হয়, দুঃখ স্থিতভাবে থাকে মনচিত্তে। আর অবিদ্যার হেতুতে নানা দুঃখে পতিত হতে হচ্ছে সত্ত্বগণকে। বিদ্যা বা জ্ঞান উদয় হলে দুঃখ উৎপত্তি হতে পারে না। বর্তমান সময়ে খুব সমাদৃত কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রাপ্ত বি.এ., এম.এ., ডক্টর ডিগ্রীসমূহ দ্বারা দুঃখরাশি ধ্বংস হবে না। তাই সেসব ডিগ্রীসমূহ প্রকৃত বিদ্যা বা জ্ঞান নয়, সেগুলোও অবিদ্যা বলে জানবে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন, স্কুল কলেজ হতে অর্জিত ডিগ্রীসমূহ উপাধি মাত্র, প্রকৃত জ্ঞান বলা যায় না। বৌদ্ধধর্ম মতে যে জ্ঞানের দ্বারা দুঃখরাশিকে নিরোধ করা যায় তাই হল বিদ্যা। এবং যে জ্ঞানের দ্বারা দুঃখ হতে চিরতরে মুক্ত হওয়া যায় সে বিদ্যা শিক্ষা করাই হল বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্য। বর্তমানে অনেকে স্কলারশীপ নিয়ে লন্ডন, আমেরিকায় বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করতে চলে যায়। কিন্তু সেসব ডিগ্রীতে দুঃখ মোচন হয় না। চারি আর্যসত্য জ্ঞানই একমাত্র জ্ঞান, যা দ্বারা দুঃখরাশিকে সম্পূর্ণরূপে নিরোধ করা যায়। তাই তোমরা চারি আর্যসত্য জ্ঞান শিক্ষা কর। সেই চারি আর্যসত্য জ্ঞান কি? দুঃখে জ্ঞান, দুঃখ-সমুদয়ে জ্ঞান, দুঃখ-নিরোধে জ্ঞান, দুঃখ-নিরোধগামিনী প্রতিপদায় জ্ঞান। দুঃখ জ্ঞানে দুঃখকে বুঝে, দুঃখের মধ্যে অবস্থান করতে বিরাগ উৎপন্ন করে। দুঃখ সমুদয় জ্ঞানে দুঃখের উৎপত্তি জ্ঞাত হয়ে তা পরিত্যাগ করে। দুঃখ-নিরোধ জ্ঞানে দুঃখ নিঃশেষে কি সুখ তা প্রত্যক্ষ করে এবং দুঃখ-নিরোধগামিনী প্রতিপদা জ্ঞানে কিভাবে দুঃখ-নিরোধ হয় সেপথ নির্দেশ করে দেয়। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান লাভের দ্বারা নানা যোনি অবলম্বনে ভবচক্রে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ হয়।

‘আমি মানুষ’ এই ধারণা মিথ্যা, ‘সে পুরুষ’ এই ধারণা মিথ্যা, ‘সে স্ত্রী’ এই ধারণা মিথ্যা। কাজেই মানুষ, পুরুষ, স্ত্রী এই সকল মিথ্যা ধারণা নিয়ে সুখভোগ করা ইচ্ছা পোষণ করো না। কারণ যা সত্য নয় মিথ্যা তা নিয়ে মশগুল না হওয়া এবং তাতে সুখভোগের আকাঙ্ক্ষা না করায় উত্তম। অজ্ঞ, মিথ্যা বা ভ্রান্তদৃষ্টি-সম্পন্নরা সুখভোগে রত থাকতে চায়। তারা আমি পুরুষ, সে স্ত্রী বলে একে অপরকে লাভ করতে ইচ্ছুক হয়। অর্থাৎ সেই স্ত্রী এবং আমি পুরুষ এই ধারণা করে করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি পুরুষ, সে স্ত্রী উভয় ধারণা মিথ্যা। এ জগতে ‘আমি আছি’ এ ধারণা মিথ্যা, ‘আমার আছে’ এ ধারণাও মিথ্যা। বস্তুতঃপক্ষে সমস্ত জগতই মিথ্যা, ভ্রান্ত, স্বপ্ন সদৃশ। একমাত্র চারি আর্যসত্য জ্ঞান, প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞানই সত্য এবং আসল।

শ্রদ্ধেয় বনভন্তে বলেন, কেহ যদি বলে আমি বৌদ্ধধর্ম বুঝতে চাই, তাহলে তাকে চারি আর্যসত্য, প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। বি.এ., এম.এ. পাশ তথা বড় বড় ডিগ্রী অর্জনের দ্বারা বৌদ্ধধর্ম বুঝা যায় না। চারি আর্যসত্য জ্ঞান লাভ, প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান লাভ হয়ে বুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করেই বৌদ্ধধর্ম বুঝতে হবে, অন্যথায় নয়। চারি আর্যসত্য জ্ঞান, প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান হল বুদ্ধজ্ঞান। চারি আর্যসত্য জ্ঞান অর্জন হলে পুনর্জন্মধারণ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ এই জ্ঞানের দ্বারা সংসারে জন্মগ্রহণ করে যে বিবিধ দুঃখভোগ করতে হয় সে দুঃখসমূহ জ্ঞাত হয়ে আর পুনর্জন্মগ্রহণের বাসনা, তৃষ্ণা থাকে না। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান লাভের দ্বারা এক ভব হতে অন্য ভবে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ হয়ে যায়। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি বা কার্যকারণ সম্বন্ধে অজ্ঞ ব্যক্তিরা ভবচক্রে ঘুরে ঘুরে মুক্তির পথ খোঁজে পাচ্ছে না। ভগবান বুদ্ধ বোধিমূলে প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান লাভ করত সংসারচক্রে পুনর্জন্ম বন্ধ হলে প্রফুল্ল চিত্তে আবেগপূর্ণ এই উদান গাথা উচ্চারণ করেছিলেন :

না পেয়ে যথার্থ চারিসত্যের দর্শন,

দীর্ঘকাল বহুযোনি করেছি ভ্রমণ।

এবার পেয়েছি সেই সত্যের দর্শন,

ভবনেত্রী, তৃষ্ণা এবে হয়েছে নিধন।

উৎপাটিত দুঃখ মূল তৃষ্ণার কারণ,

পুনর্ভব পুনর্জন্ম নাহিরে এখন।

সংসার বা ভবচক্রে পুনঃপুন জন্মগ্রহণ করা যে দুঃখ, মিথ্যাদৃষ্টি পরিবর্ধক ও পরিপোষক তা প্রকাশ করতে বুদ্ধ বক ব্রহ্মকে বলেছিলেন :

ভবে আমি দেখি ভব খুঁজিনু বিভব,

বিভব খুঁজিতে গিয়ে দেখিলাম ভব।

ভব অন্বেষণ তাই করি নাই আর,

ভব তৃষ্ণা ভবাসক্তি করি পরিহার।

স্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী মার্গলাভীর মিথ্যাদৃষ্টি আসব সমূলে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে কামাসব, ভবাসব, অবিদ্যাসব সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় না। অনাগামী মার্গলাভীর কামাসব, মিথ্যাদৃষ্টি আসব ধ্বংস হয়ে যায়; তবে তারাও ভবাসব, অবিদ্যাসব হতে সম্পূর্ণ মুক্ত নন। অর্হত্ত্বমার্গলাভীরা কামাসব, ভবাসব, দৃষ্টি আসব, অবিদ্যাসব হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। তারা চতুর্বিধ আসবকে সমূলে ক্ষয়, ধ্বংস সাধন করে থাকেন।

মার্গফল লাভেচ্ছুক প্রব্রজিতগণ হীনদৃষ্টি, পাপদৃষ্টি সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করবে। পাপদৃষ্টি উৎপন্ন হলে প্রব্রজ্যা ত্যাগ করে একজন সুন্দরী রমণীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করত সংসারী বা সাধারণ গৃহী অবস্থায় জীবন-যাপন করাকে সুখ বলে মনে হবে। আর হীনদৃষ্টি উৎপন্ন হলে প্রব্রজ্যা ত্যাগ করে চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা যেকোনো পেশা অবলম্বে ধর্ম-পুণ্য কর্ম করত একদিকে লৌকিক সুখ অন্যদিকে ধীরে ধীরে লোকোত্তর সুখে উন্নীত হবো এরূপ ইচ্ছা জন্মাবে। পাপদৃষ্টি, হীনদৃষ্টি ত্যাগ না করলে কেহ প্রব্রজিত অবস্থায় সুখে থাকতে পারে না। তোমরা পাপদৃষ্টি, হীনদৃষ্টি হতে সজাগ থাক এবং এরূপ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও যে, ‘আমরা পাপদৃষ্টি, হীনদৃষ্টি উৎপন্ন হতে দেবো না। পাপদৃষ্টি, হীনদৃষ্টি-সম্পন্ন চিত্তে কিছুতেই অবস্থান করবো না।’

অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান ত্যাগ কর। প্রব্রজিত হয়ে যদি অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদানের সহিত অবস্থান কর তাহলে বাংলাদেশে তৈরি রেডিও লেবেলে মেড ইন জাপান লেখা সদৃশ হবে। তোমরা যে কাষায় বস্ত্র পরিধান করেছ তা বাইরের লেবেলে মেইড ইন জাপান লেখেছ। অর্থাৎ অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদানের সহিত অবস্থান করব না এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছ। এখন যদি মনচিত্ত হতে অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান মূলোচ্ছেদ কর তাহলে প্রকৃত জাপানের তৈরি রেডিও হবে। মেড ইন জাপান রেডিও অর্থ প্রকৃত ভিক্ষু। বাংলাদেশে তৈরি কিন্তু লেবেলে মেড ইন জাপান লেখা অর্থ মিথ্যা ভিক্ষু, ছদ্মবেশী ভিক্ষু। বর্তমানে অধিকাংশ ভিক্ষুই অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান ত্যাগ করতে পারছে না। তারা বাংলাদেশের তৈরি রেডিও কিন্তু লেবেলে মেইড ইন জাপান লেখে অবস্থান করতেছে। অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান ত্যাগ করতে না পারলে দুঃখ পেতে হবে, দুঃখ থেকে মুক্ত হতে পারবে না, এমন কি নিরয়গামীও হতে পারে। অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান প্রহীন হলে দুঃখ হতে মুক্তি লাভ হয়। অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান প্রহীন করতে তোমাদেরকে শীত, উষ্ণ, ক্ষুধা, পিপাসা, ডংশ, মশক সহ নানাবিধ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে গভীর অরণ্যে ধ্যান সাধনা করতে হবে। ভগবান বুদ্ধ রাজার পুত্র হয়েও যদি ছয় বৎসর শীত, উষ্ণ, ক্ষুধা, পিপাসা, ডংশক, মশকের উপদ্রব সহ নানাবিধ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারেন তাহলে তোমরা কেন পারবে না? আমি যখন জঙ্গলে ছিলাম তখন বেশি দুঃখ অনুভব হলে বুদ্ধ, শারীপুত্র, মৌদ্গল্যায়ন, আনন্দ, মহাকাশ্যপ প্রমুখ মহাত্যাগীদের কথা স্মরণ করতাম। তাঁরা রাজার ছেলে, বড় বড় ধনী ছেলে হয়ে যদি কষ্ট সহ্য করতে পারেন আমি সাধারণ পরিবারের ছেলে হয়ে কেন পারব না? এরূপ ভেবে পুনঃ মনের মধ্যে বীর্য উৎপন্ন করতাম। আরো স্মরণ করতাম মহাজ্ঞানী শারীপুত্রের উপদেশসমূহ। শারীপুত্র বলেছিলেন :

চংক্রমণে, দাঁড়ানোতে হয়ে উপবিষ্টা,

বনে শোভা পায় ভিক্ষু, বন হয় প্রসংশিতা।

আপনার চিত্ত তুমি একাকী দমিবে,

বনান্তে সেইরূপ আনন্দ পাইবে।

সে-সকল উপদেশসমূহ বারবার স্মরণ করে আমি জঙ্গলের মধ্যে খুশী মনে অবস্থান করতে সক্ষম হতাম, উৎসাহিত হতাম। জঙ্গলের মধ্যে একাকী অবস্থানের জন্য দৃঢ়বীর্য উৎপাদন করতাম। তোমরাও মনচিত্ত থেকে অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান ত্যাগ করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হও। চিত্ত দমনের অনুকূল পরিবেশ জঙ্গলে প্রবেশ করে নিজের চিত্ত নিজে দমন করো। তাতে অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান নিরোধ হওত বিমুক্ত সুখের অধিকারী হবে। তবে তোমরা যদি লাভ তৃষ্ণায় বশীভূত হয়ে থাক তাহলে বন জঙ্গলে অবস্থান করতে সমর্থ হবে না। বুদ্ধ বলেছেন, লাভ, তৃষ্ণায় বশীভূত হলে বন জঙ্গলে বাস করতে কষ্টকর মনে হয়। লাভ-তৃষ্ণা বশীভূত মনে বন-জঙ্গলে অবস্থান করলে মন দুঃখে পতিত হয়, কষ্ট পায়। তখন দুঃখ-কষ্টে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করা ছাড়া আর কিছুই হয় না। তোমরা যখন প্রব্রজিত হয়েছ দুঃখ কে ভয় কর, অকুশলে লজ্জা জ্ঞান উদয় কর। বুদ্ধের শাসনে প্রব্রজিত দুঃখকে ভয় করে সংসার দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করতে হয়। এ সংসার দুঃখে ভরা, এখানে সুখ বিন্দুমাত্র নেই এই ভেবে দুঃখজ্ঞান উদয় করতে হবে। প্রব্রজিত হয়ে যদি সংসার সুখ বলে দৃষ্ট হয় তাহলে প্রব্রজিত জীবনে কখনো শান্তি, সুখ লাভ হবে না। এবং তাদের নির্বাণ লাভের আশা হবে গুড়েবালি সদৃশ। বুদ্ধ বলেছেন, জগতে যত প্রকার দুঃখ পেতে হয় তৎ সমস্ত এ দেহধারণের দরুন। এই দুঃখদায়ক দেহধারণ না করলে দুঃখ কোথা হতে উৎপন্ন হবে। তাই জন্ম হলে দুঃখ পেতে হয়, দেহধারণে দুঃখ পেতেই হয়। তোমরা পুনর্জন্ম রোধ কর, দেহধারণ করা বন্ধ কর তাহলে নির্বাণ সুখ লাভ হবে।

পরিশেষে তিনি বলেন, তোমরা সম্যক সমাধি দ্বারা চারি আর্যসত্য জ্ঞান, প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান, আসবক্ষয় জ্ঞান অর্জন কর; তাতে তোমাদের প্রকৃত সুখ লাভ হবে। চারি আর্যসত্য জ্ঞানে দুঃখসমূহ যেমন দৃষ্টিগোচর হয় তেমনি দুঃখ-নিরোধের উপায়ও প্রদর্শিত হয়। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান দ্বারা জন্মগ্রহণ তথা দুঃখের কার্য-কারণের হেতু নিরোধ হয়। আসবক্ষয় জ্ঞান দ্বারা ভাবী সংসারস্রাবের পথ রুদ্ধ হয়। আমি অভিজ্ঞ দ্বারা জানতে পারছি যে, বৌদ্ধধর্মে লোকোত্তরই একমাত্র সুখ। লৌকিক সুখ স্বপ্ন সদৃশ, প্রকৃতপক্ষে তা দুঃখই বলতে হয়। মারভুবন হল লৌকিক আর অমারভুবন হল লোকোত্তর। তোমরা মারভুবন ত্যাগ করে অমারভুবনে চলে যাও। মারভুবন অধীন, ভয়ঙ্কর, মুক্ত নেই, নিরাপত্তা নেই। পক্ষান্তরে অমারভুবন মুক্ত, সুখ, স্বাধীন, নির্ভয় ও নিরাপদ। স্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী, অনাগামী, অর্হত মার্গস্থ-ফলস্থ আর নির্বাণ এই নব লোকোত্তরধর্ম লাভ প্রকৃত সুখ ও নিরাপদ অবস্থা, যাকে অমারভুবন বলা হয়। অজ্ঞানী ব্যক্তিরা কিন্তু মারভুবন অমারভুবন কিছুই চিনে না। যেমন একটা গরু বনরূপাতে অবস্থান করলেও কি বনরূপা চিনে? বা বলতে পারে কি সে বনরূপায় আছে? ঠিক তদ্রূপ অজ্ঞানীর মনচিত্ত মারভুবনে অবস্থান করলেও তারা তা জানে না। এবং সে দুঃখ পাচ্ছে তাও সঠিকভাবে জানে না। কিন্তু জ্ঞানীরা এটা মারভুবন, এখানে দুঃখ আমি দুঃখের মধ্যে অবস্থান করবো না, বরং অমারভুবনে চলে যাবো এসবই তার জ্ঞানদৃষ্টিতে ধরা পড়ে। আবার, মারভুবনকে মৃত্যুরাজ্য, অমারভুবনকে অমৃত্যুরাজ্য বলে। তোমরা মারভুবন ত্যাগ করে অমারভুবনে চলে যাও, এবং মারভুবন, অমারভুবন, মৃত্যুরাজ্য, অমৃত্যুরাজ্য, ইহলোক, পরলোক, চিত্ত সংযম ও শমথ-বিদর্শন সম্বন্ধে দক্ষতা অর্জন কর। এসব সম্বন্ধে দক্ষতা লাভ হলে নির্বাণ সুখ প্রত্যক্ষ হয়। দক্ষতা লাভ করার অর্থ জ্ঞানী পণ্ডিত হওয়া; তোমরা জ্ঞানী, পণ্ডিত হও; দিনে দিনে পাণ্ডিত্য অর্জন কর। পণ্ডিতেরা মারের প্রলোভনে প্রলুব্ধ না হয়ে জগতের কোনো বিষয়ের প্রতি রমিত হন না।

তোমরা নির্বাণের মন, নির্বাণের চিত্ত হয়ে অবস্থান কর। নির্বাণের মন, নির্বাণের চিত্ত হলে নির্বাণ লাভ হয়। প্রব্রজ্যা ত্যাগ করার মন, বিয়ে করার মন, চাকুরি করার মন হলে নির্বাণ হতে শত সহস্র মাইলের দূরে থাকতে হবে। কোনো মতে আর নির্বাণের কাছে পৌঁছতে সম্ভব হবে না। নির্বাণ যেতে হলে নির্বাণের মন, নির্বাণের চিত্ত হয়ে অবস্থান করতে হয়।

সাধু, সাধু, সাধু।