বৌদ্ধধর্মমতে, নির্বাণ লাভ না করা পর্যন্ত সবারই পুণ্যকর্ম করা দরকার। ধর্মপদে বুদ্ধ বলেছেন, কেউ যদি পুণ্যকর্ম করে তাহলে সেটা যেন সে বারবার করে, তা যেন সে সবসময় আকাঙ্খা করে, কারণ পুণ্যসঞ্চয় হচ্ছে সুখদায়ক (ধম্মপদ-১১৮)।
কিন্তু কোন কোন কাজগুলো পুণ্যকর্ম হিসেবে গণ্য হয়? অভিধর্মপিটকের ধর্মসঙ্গণি অর্থকথামতে সেগুলো হচ্ছে দশ প্রকার কাজ, যেমন- দানজনিত পুণ্যকর্ম, শীলজনিত পুণ্যকর্ম, ভাবনাজনিত পুণ্যকর্ম, সম্মান প্রদর্শনজনিত পুণ্যকর্ম, সেবামূলক পুণ্যকর্ম, পুণ্যদানজনিত পুণ্যকর্ম, অনুমোদনমূলক পুণ্যকর্ম, দেশনাজনিত পুণ্যকর্ম, শ্রবণজনিত পুণ্যকর্ম, সম্যকদৃষ্টি গঠনকারী কর্মজনিত পুণ্যকর্ম। এই হচ্ছে দশপ্রকার পুণ্যকর্ম।
দানজনিত পুণ্যকর্ম কী কী? অনেকভাবে দান করা যায়। ভিক্ষুদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন- চীবর, ভিক্ষান্ন, বাসস্থান, ওষুধপত্র ইত্যাদি ভিক্ষুসঙ্ঘকে দান করা যায়। অাবার রূপ, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ অথবা মানসিক বিষয়মূলক যেকোনোকিছু দান করা যায়। আবার বৌদ্ধদের চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী দশ প্রকার দানীয় বস্তু রয়েছে, যেমন- অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, যানবাহন, মালা, সুগন্ধি, প্রলেপন, শয্যা বা বিছানা, আবাস, প্রদীপ। সেগুলোও দান করা যায়। দান করার উদ্দেশ্যে এসমস্ত জিনিস সংগ্রহ করার সময়ে যেসমস্ত কুশল চেতনা উৎপন্ন হয় সেগুলো সবই হচ্ছে দানজনিত পুণ্যকর্ম।
দানের আগে, দানের সময়ে এবং দানের পরে খুশিমনে স্মরণকালেও যেসমস্ত কুশল চেতনা উৎপন্ন হয় সেগুলো সবই হচ্ছে দানজনিত পুণ্যকর্ম। এভাবে একটা দানানুষ্ঠানের মাধ্যমে যে কত অসংখ্য কুশল চেতনা উৎপন্ন হয় তার সীমা নেই। সেগুলোর কিছু ইহজন্মেই ফল দেয়, কিছু পরবর্তী জন্মে ফল দেয়, বাকিগুলো পরিনির্বাপিত না হওয়া পর্যন্ত যেখানেই সুযোগ পায় সেখানেই ফল দিয়ে থাকে। কাজেই যেকোনো দান অনুষ্ঠানের আগে ও পরে সবসময় খেয়াল রাখবেন যেন কুশল চেতনা বজায় থাকে।
দানের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধভাবে দান করাও গুরুত্বপূর্ণ। তার জন্য চারটি বিষয় থাকতে হয়- ন্যায্য দ্রব্যসামগ্রী, মহাচেতনা, ক্ষেত্রসম্পত্তি, অতিরিক্ত গুণ। দাতার দ্রব্যসামগ্রী যদি ধর্মত ও ন্যায্যভাবে প্রাপ্ত হয় তা হয় ধর্মসঙ্গত। দাতা যদি দানের ফল আছে বলে বিশ্বাস করে শ্রদ্ধাভরে দান দেয় তাহলে সেটা হয় তার মহাচেতনা। অন্যদিকে গ্রহীতা যদি আসবহীন অর্হৎ হয় তা হয় ক্ষেত্রসম্পত্তি। আবার গ্রহীতা যদি অর্হৎ হয় এবং নিরোধধ্যান থেকে উঠে যায়, তখন সেই অবস্থার নাম হয় অতিরিক্ত গুণ। এই চারটি গুণের সম্মিলন করে দান করতে সক্ষম হলে সেই কামাবচর কুশল পুণ্যকর্ম খুবই শক্তিশালী হয় এবং ইহজন্মেই ফল দেয়। পুণ্ণক শ্রেষ্ঠী, কাকবলি, সুমন মালাকার ইত্যাদিরাও এভাবে ইহজন্মেই ফল পেয়েছিল।
গৃহীদের পঞ্চশীল, অষ্টশীল ও দশশীল গ্রহণ ও শীল রক্ষার সময়ে চলমান চেতনাগুলো হচ্ছে শীলময় পুণ্যকর্ম। প্রব্রজিতদের প্রব্রজ্যা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ‘প্রব্রজিত হবো’ এই মন নিয়ে বিহারে গমনের সময়ে, প্রব্রজ্যার সময়ে, ‘মনস্কামনা পূর্ণ হলো, আমি এখন প্রব্রজিত, সাধু সাধু’ এভাবে নিজের প্রব্রজ্যা পর্যালোচনার সময়ে, পাতিমোক্ষ শীলে সংযত থাকার সময়ে, চীবর ইত্যাদি জিনিস ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রত্যবেক্ষণ বা পর্যালোচনার সময়ে, দৃষ্টিপথে রূপ ইত্যাদি আসলেও চোখ, কান ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গুলো সংযত রাখার সময়ে, এবং জীবিকা পরিশুদ্ধ করার সময়ে চলমান চেতনাগুলো হচ্ছে শীলময় পুণ্যকর্ম।
প্রতিসম্ভিদায় উল্লেখিত বিদর্শনপদ্ধতিতে চোখকে অনিত্য হিসেবে, দুঃখ হিসেবে, অনাত্ম হিসেবে ভাবনাকালে … মনকে … রূপগুলোকে … ধর্ম বা বিষয়গুলোকে … চোখবিজ্ঞানকে … মনোবিজ্ঞানকে … চোখসংস্পর্শকে … মনসংস্পর্শকে … চোখসংস্পর্শ থেকে উৎপন্ন বেদনাকে … মনসংস্পর্শ থেকে উৎপন্ন বেদনাকে … রূপসংজ্ঞাকে … জরামরণকে অনিত্য হিসেবে, দুঃখ হিসেবে, অনাত্ম হিসেবে ভাবনাকালে চলতে থাকা চেতনাগুলো, অথবা আটত্রিশ প্রকার ধ্যানের যেকোনোটাতে মনটা একাগ্র না হওয়া পর্যন্ত সবগুলো চেতনা হচ্ছে ভাবনাময় পুণ্যকর্ম।
গৃহীদের ক্ষেত্রে পিতামাতা, শিক্ষক, ভিক্ষু-শ্রামণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠদেরকে অভিবাদন করা, সসম্মানে পথ ছেড়ে দেয়া, ইত্যাদি নানাপ্রকারে যথাযোগ্য ব্যক্তিদেরকে সম্মান প্রদর্শন হচ্ছে সম্মানপ্রদর্শন সংশ্লিষ্ট পুণ্যকর্ম। ভিক্ষুদের ক্ষেত্রে সিনিয়র ভিক্ষুদেরকে দেখে এগিয়ে গিয়ে তাদের পাত্রচীবর গ্রহণ করা, অভিবাদন করা, সসম্মানে পথ ছেড়ে দেয়া ইত্যাদিকে সম্মানপ্রদর্শন সংশ্লিষ্ট পুণ্যকর্ম বলে বুঝতে হবে।
গৃহীদের ক্ষেত্রে পিতামাতা, শিক্ষক, ভিক্ষু-শ্রামণ এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের নানা কাজ করে দেয়া, রোগীর সেবা করা ইত্যাদি সেবামূলক কাজগুলো হচ্ছে সেবাসংশ্লিষ্ট পুণ্যকর্ম। ভিক্ষুদের ক্ষেত্রে সিনিয়র ভিক্ষুদের প্রতি করণীয় ব্রত ও অন্যান্য কায়িক সেবা প্রদানকালে চলতে থাকা চেতনাগুলো সেবাসংশ্লিষ্ট পুণ্যকর্ম বলে বুঝতে হবে।
দান দিয়ে, সুগন্ধি ইত্যাদি দ্বারা পূজা করে ‘অমুকের পুণ্য হোক’ অথবা ‘এই পুণ্য সকল সত্ত্বের হোক’ এভাবে পুণ্য দান করাকেই পুণ্যপ্রদানের পুণ্যকর্ম বলে বুঝতে হবে। এভাবে পুণ্য ভাগ দিলে কি পুণ্য ক্ষয় হয়? হয় না। যেমন একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে তা থেকে হাজারো প্রদীপ জ্বালালেও প্রথম প্রদীপকে অনুজ্জ্বল বলা যায় না, বরং তখন প্রথম প্রদীপের আলোর সাথে পরবর্তী প্রদীপগুলোর আলোও একত্রিত হয়ে বিশাল আলো হয়ে ওঠে। এভাবেই পুণ্য বিতরণকালে কোনো ক্ষতি নেই, বরং লাভই হয় বলে বুঝতে হবে।
অন্যের দেয়া পুণ্য অথবা অন্যের কোনো ভালোকাজ বা পুণ্যকাজকে ‘সাধু সাধু’ বলে অনুমোদন বা সমর্থনের মাধ্যমে অনুমোদনের পুণ্যকর্ম হয় বলে বুঝতে হবে।
কেউ কেউ ‘এভাবে আমাকে সবাই ধর্মীয় বক্তা হিসেবে জানবে’ এই ইচ্ছায় লাভপ্রত্যাশী হয়ে ধর্মদেশনা করে, তা মহাফলদায়ক হয় না। কেউ কেউ কোনো প্রত্যাশা না করে বিমুক্তিকে মাথায় রেখেই নিজের সুপরিচিত ধর্মকে অন্যের কাছে দেশনা করে, সেটাই হচ্ছে দেশনাময় পুণ্যকর্ম।
কেউ কেউ দেশনা শুনতে শুনতে ‘এভাবে আমাকে সবাই শ্রদ্ধাবান বলে জানবে’ মনে এমন ভাব নিয়ে দেশনা শোনে, তা মহাফলদায়ক হয় না। কেউ কেউ ‘এভাবে আমার মহাফল লাভ হবে’ এভাবে মঙ্গলাকাঙ্খী হয়ে মৃদু কোমল চিত্ত নিয়ে ধর্মদেশনা শোনে, সেটাই হচ্ছে শ্রবণময় পুণ্যকর্ম।
অনেকেরই বিভিন্ন ধরনের ভুল ধারণা থাকে। যেমন কেউ কেউ দানের ফল বিশ্বাস করে না। স্বর্গনরক আছে বলে বিশ্বাস করে না। অদৃশ্য দেবতা আছে বলে বিশ্বাস করে না। বিভিন্ন ধরনের ভুল ধারণা পোষণ করে। বিভিন্ন বই পড়ে, দেশনা শুনে, ভাবনা করে অথবা আলোচনার মাধ্যমে এসব ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করার কাজে রত থাকলে তা হয় ‘দৃষ্টিভঙ্গি ঋজুকারী কর্মের পুণ্যকর্ম’।
এই পুণ্যকর্মগুলোর মধ্যে ‘দান দেব’ বলে চিন্তা করার সময়ে দানময় পুণ্যকর্ম উৎপন্ন হয়, দান দেয়ার সময়ে এবং ‘দান দিয়েছি’ বলে পর্যালোচনা করার সময়েও দানময় পুণ্যকর্ম উৎপন্ন হয়। এভাবে পূর্ববর্তী চেতনা, ত্যাগকালীন চেতনা এবং পরবর্তী চেতনা, এই তিন প্রকার চেতনাকে একত্রে ‘দানময় পুণ্যকর্ম’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। শীলময় পুণ্যকর্মও ‘শীল পূরণ করব’ চিন্তা করার সময়ে উৎপন্ন হয়, শীল পূরণকালে উৎপন্ন হয়, ‘আমার শীল পূরণ হয়েছে’ এভাবে পর্যালোচনাকালে উৎপন্ন হয়। সেগুলো সব একত্র করে ‘শীলময় পূণ্যকর্ম’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। … দৃষ্টিভঙ্গি ঋজুকারী পুণ্যকর্মও ‘দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করব’ এমন চিন্তা করার সময়ে উৎপন্ন হয়, দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করার সময়ে উৎপন্ন হয়, ‘আমি দৃষ্টিভঙ্গি সোজা করেছি’ এমন পর্যালোচনাকালে উৎপন্ন হয়। সেগুলো সব একত্র করে ‘দৃষ্টিভঙ্গি ঋজুকারী পুণ্যকর্ম’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
সুত্রে কিন্তু কেবল দান, শীল ও ভাবনা – এই তিন প্রকার পুণ্যকাজের কথা বলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বাদবাকি পুণ্যকর্মও অন্তর্ভুক্ত বলে বুঝতে হবে। সম্মান প্রদর্শন ও সেবার কর্মগুলো শীলময় পুণ্যকাজের অন্তর্গত হয়। পুণ্যদান, পুণ্য অনুমোদনের কর্মগুলো দানময় পুণ্যকাজের অন্তর্গত হয়। ধর্মদেশনা করা, ধর্মদেশনা শ্রবণ, সম্যকদৃষ্টি গঠনকারী কর্মগুলো ভাবনাময় পুণ্যকাজের অন্তর্গত হয়। এভাবে এগুলো সংক্ষেপে তিনটি হলেও বিস্তারিতভাবে বললে দশটি পুণ্যকর্ম হয়।
আবার এই স্থানে ছয় প্রকার পুণ্যসঞ্চয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পুণ্য স্বয়ংকৃত অাছে, পরকৃত আছে, স্বহস্তকৃত আছে, আদিষ্ট আছে, সম্প্রজ্ঞানেকৃত আছে, অসম্প্রজ্ঞানেকৃতও আছে।
এগুলোর মধ্যে নিজের স্বভাববশত পুণ্য করলে সেটা হয় স্বয়ংকৃত। অন্যকে করতে দেখে করলে হয় পরকৃত। নিজ হাতে পুণ্য করলে হয় স্বহস্তেকৃত। আদেশ দিয়ে করালে সেটা হয় আদিষ্ট। কর্ম ও ফলের প্রতি বিশ্বাস রেখে পুণ্য করলে হয় সম্প্রজ্ঞানেকৃত । কর্ম ও ফলকে না জেনে করলে হয় অসম্প্রজ্ঞানেকৃত। এসব পুণ্যকর্ম করার সময়ে আটটি কুশল চিত্তের কোনো একটি চিত্ত দ্বারা করা হয়ে থাকে।
পুণ্যকর্মের ব্যাপারে তো জানলেন। এবার নিজের অবস্থা একটু চিন্তা করুন। বর্তমানে মানুষ বাঁচে বড় জোর ৭০-৮০ বছর। আর কত বছর বাঁচবেন আপনি হিসেব করুন তো। এবার একটু মন দিয়ে চিন্তা করুন- জীবনের যে বছরগুলো ফেলে এসেছেন সেগুলোতে কি যথেষ্ট পুণ্য সঞ্চয় হয়েছে? আগামী যে কয়টা বছর বাঁচবেন সেগুলো কি পুণ্যসঞ্চয়ের পরিকল্পনা করেছেন কি? আপনার দৈনন্দিন জীবনে উপরোক্ত পুণ্যকাজগুলো করা হচ্ছে তো? প্রতিদিন যাতে অন্তত উপরোক্ত যেকোনো একটি পুণ্যকাজ হয় সেভাবে একটা পরিকল্পনা করুন। এখনি শুরু করে দিন। শুভকাজে দেরি করতে নেই।
Gansanta.org থেকে নেওয়া