শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০২৫

ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্ম পুনর্জাগরণের অগ্রদূত অনাগরিক ধর্মপাল

অনাগরিক ধর্মপাল
২৬ জুলাই ২০২৫, শুক্রবার: বৌদ্ধ ধর্মের পুনরুজ্জীবন এবং এর বিশ্বব্যাপী প্রচারে অনাগরিক ধর্মপালের ভূমিকা আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। ১৮৬৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় জন্ম নেওয়া ডন ডেভিড হেওয়া বিতরণ, যিনি পরবর্তীতে 'অনাগরিক ধর্মপাল' নামে পরিচিত হন, তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বুদ্ধের ধম্ম প্রচারে।

অনাগরিক ধর্মপাল কেবল একজন বৌদ্ধ পণ্ডিতই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ ধর্মপ্রচারক এবং সমাজ সংস্কারক। মাত্র ১৪ বছর বয়সে থিওসোফিক্যাল সোসাইটির সাথে যুক্ত হয়ে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন শুরু করেন। খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে অধ্যয়নকালে তাঁকে ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, বরং তিনি নিজেই সহপাঠীদের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে থাকেন।

মহাবোধি সোসাইটি প্রতিষ্ঠা ও বুদ্ধগয়া পুনরুদ্ধার আন্দোলন

ধর্মপালের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল ১৮৯১ সালে বুদ্ধগয়া ভ্রমণ। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্রতম স্থানগুলির অবহেলা দেখে তিনি ব্যথিত হন এবং এর হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের সংকল্প করেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি ১৮৯১ সালের ৩১ মে শ্রীলঙ্কায় মহাবোধি সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছর ১৮৯২ সালে এর মূল কার্যালয় কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়, যা ভারতে বৌদ্ধধর্মের পুনরুত্থানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। মহাবোধি সোসাইটির মাধ্যমে তিনি বুদ্ধগয়া মন্দির পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন শুরু করেন, যা পরবর্তীতে ব্যাপক সাফল্য লাভ করে।

বিশ্ব ধর্ম মহাসম্মেলনে ধর্মপালের প্রভাব

১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত 'ওয়ার্ল্ডস পার্লামেন্ট অফ রেলিজিয়নস' (The World's Parliament of Religions) সম্মেলনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে অনাগরিক ধর্মপাল অংশগ্রহণ করেন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ ও প্রভাবশালী বক্তব্য বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে এবং তাঁকে সম্মেলনের অন্যতম জনপ্রিয় বক্তা হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। এই সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের বাণীকে পাশ্চাত্যে পৌঁছে দেন।

সমাজসেবা ও ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের সাথে সম্পর্ক

ধর্মপাল কেবল ধর্মীয় প্রচারেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি সমাজসেবামূলক কাজেও সক্রিয় ছিলেন। ১৮৯৭ সালে যখন বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন তিনি বিশ্বের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন। ভারতীয় মেধার সমন্বয় সাধন ছিল তাঁর একটি বিশেষ উদ্দেশ্য। তিনি মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এস রাধাকৃষ্ণান প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের মহাবোধি সোসাইটির সাথে যুক্ত করেছিলেন, যারা তাঁর কাজে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন।

সারনাথ ও শেষ জীবন

ধর্মপাল সারনাথে বুদ্ধের ধর্মচক্রপ্রবর্তন স্থানের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মহাবোধি সোসাইটির মাধ্যমে লাভ করেন। ১৯২২ সালে তিনি সারনাথ মূলগন্ধকূটি বিহারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং সেখানে ধর্মশালা, ইন্টারন্যাশনাল বুদ্ধিস্ট ইনস্টিটিউট ও একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলেন। ১৯৩১ সালে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং 'শ্রী দেবমিত্র ধর্মপাল' নাম ধারণ করেন। ১৯৩৩ সালের ২৯ এপ্রিল সারনাথে এই মহান ব্যক্তিত্ব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ভস্মাবশেষ সারনাথের মূলগন্ধকূটি বিহারের সামনে স্থাপন করা হয়েছে।

অনাগরিক ধর্মপাল কেবল শ্রীলঙ্কাতেই নয়, ভারতসহ বিশ্বজুড়ে বৌদ্ধ ধর্মের পুনরুজ্জীবন ও প্রচারে এক অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন, যা আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।


শেয়ার করুন

Administrator: হিমেল বড়ুয়া

যদি(কিছু_জানো){ জানাে(); }নয়তো{ জানো();