আর্যশ্রাবক বনভন্তের ধর্মদেশনা
সংকলক : শ্রীমৎ ইন্দ্রগুপ্ত ভিক্ষু
অবিদ্যা হতে যাবতীয় দুঃখের সৃষ্টি
একসময় বনভন্তে নিজ আবাসিক ভবনে ভিক্ষুসঙ্ঘকে দেশনা প্রদান প্রসঙ্গে বলেন, এ দেহ অসার, মূল্যহীন; দেহে কোনো সার নেই, কোনো মূল্য নেই শুধু অশুচি পদার্থে ভরা। তাই জ্ঞানীজনেরা দেহের প্রতি সর্বদা অনাসক্ত থাকেন। তোমরা দেহের প্রতি মমতা ত্যাগ কর, দেহকে নিয়ে নানাবিধ ভোগের আকাঙ্ক্ষা করিও না। সারহীন, মূল্যহীন দেহে কিসের ভোগ? কিসের আসক্তি? দেহকে অশুচি জ্ঞানে দর্শন করলে দেহের প্রতি আসক্তিভাব উৎপত্তি হয় না। দেহ হতেই নানাবিধ দুঃখ, ভয়ের কারণ উৎপন্ন হয়; দেহকে যত ত্যাগ করা যায় ততই সুখ। যেইজন দেহকে যত ত্যাগ করতে পারছে সেইজন তত বেশি সুখে অবস্থান করতেছে বলে জানবে।
প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি সম্বন্ধে জ্ঞান থাকলে ধর্মের প্রতি সন্দিহানভাব দূর হয় এবং দৃঢ় বিশ্বাস উৎপন্ন হয়। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি সম্বন্ধে অজ্ঞান হলে ধর্মের প্রতি সন্দেহ উৎপন্ন হয়, অবিশ্বাস ভাব জন্মে। চারি আর্যসত্য সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকলে জগতে সুখ খোঁজে বেড়াতে হয়। স্ত্রী-পুত্র, ধন-জন, ভোগ-ঐশ্বর্য নিয়ে সংসারী হয়ে সুখাকাঙ্ক্ষী হয়। কামলোক, রূপলোক, অরূপলোক এই ত্রিলোকে ঘুরে ঘুরে সুখ অন্বেষণ করতে হয়। চারি আর্যসত্য সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ হলে ত্রিলোকের মধ্যে কোনোপ্রকার সুখ অন্বেষণ করে না স্ত্রী-পুত্র, ধন-জন দ্বারা সংসারী হয়ে সংসারে সুখ দেখে না এবং কোথাও সুখ অন্বেষণ করে না। এককথায় সুখের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান হলে সদ্ধর্মে সন্দেহ উদয় হয় না, সংস্কাররাশি উৎপন্ন হয় না। মনচিত্ত কুশল-সংস্কার, অকুশল-সংস্কার, আনেঞ্জা-সংস্কার কোনোপ্রকার সংস্কারে লিপ্ত থাকে না। সংস্কারের অপর নাম হল কর্ম। যেই ভিক্ষুর বিদ্যা উৎপত্তি হয়েছে সেই ভিক্ষু কুশল-সংস্কারও উৎপন্ন করে না, অকুশল-সংস্কারও উৎপন্ন করে না এবং আনেঞ্জা-সংস্কারও উৎপন্ন করে না; তাতেই তিনি পরম সুখে থাকেন। অবিদ্যাকে বিদ্যা উৎপত্তি দ্বারা সম্পূর্ণরূপে নিরোধ করতে পারলে সংস্কাররাশি উৎপন্ন হয় না। সংস্কাররাশি উৎপন্ন না হলে দুঃখরাশিও উৎপন্ন হয় না। এভাবে দুঃখরাশি নিরোধ হলে নির্বাণ সুখ লাভ হয়।
অবিদ্যা হতে যাবতীয় দুঃখরাশির উৎপত্তি, অবিদ্যা না থাকলে দুঃখরাশিও নেই। তাই বলা যায়, দুঃখ কোথা হতে আসতেছে? অবিদ্যা থেকে। দুঃখ কেন ধ্বংস হচ্ছে না? অবিদ্যার কারণে বা হেতুতে। এসব থেকে প্রমাণ মিলে যে, অবিদ্যা হতেই দুঃখ উদয় হয়, দুঃখ স্থিতভাবে থাকে মনচিত্তে। আর অবিদ্যার হেতুতে নানা দুঃখে পতিত হতে হচ্ছে সত্ত্বগণকে। বিদ্যা বা জ্ঞান উদয় হলে দুঃখ উৎপত্তি হতে পারে না। বর্তমান সময়ে খুব সমাদৃত কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রাপ্ত বি.এ., এম.এ., ডক্টর ডিগ্রীসমূহ দ্বারা দুঃখরাশি ধ্বংস হবে না। তাই সেসব ডিগ্রীসমূহ প্রকৃত বিদ্যা বা জ্ঞান নয়, সেগুলোও অবিদ্যা বলে জানবে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন, স্কুল কলেজ হতে অর্জিত ডিগ্রীসমূহ উপাধি মাত্র, প্রকৃত জ্ঞান বলা যায় না। বৌদ্ধধর্ম মতে যে জ্ঞানের দ্বারা দুঃখরাশিকে নিরোধ করা যায় তাই হল বিদ্যা। এবং যে জ্ঞানের দ্বারা দুঃখ হতে চিরতরে মুক্ত হওয়া যায় সে বিদ্যা শিক্ষা করাই হল বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্য। বর্তমানে অনেকে স্কলারশীপ নিয়ে লন্ডন, আমেরিকায় বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করতে চলে যায়। কিন্তু সেসব ডিগ্রীতে দুঃখ মোচন হয় না। চারি আর্যসত্য জ্ঞানই একমাত্র জ্ঞান, যা দ্বারা দুঃখরাশিকে সম্পূর্ণরূপে নিরোধ করা যায়। তাই তোমরা চারি আর্যসত্য জ্ঞান শিক্ষা কর। সেই চারি আর্যসত্য জ্ঞান কি? দুঃখে জ্ঞান, দুঃখ-সমুদয়ে জ্ঞান, দুঃখ-নিরোধে জ্ঞান, দুঃখ-নিরোধগামিনী প্রতিপদায় জ্ঞান। দুঃখ জ্ঞানে দুঃখকে বুঝে, দুঃখের মধ্যে অবস্থান করতে বিরাগ উৎপন্ন করে। দুঃখ সমুদয় জ্ঞানে দুঃখের উৎপত্তি জ্ঞাত হয়ে তা পরিত্যাগ করে। দুঃখ-নিরোধ জ্ঞানে দুঃখ নিঃশেষে কি সুখ তা প্রত্যক্ষ করে এবং দুঃখ-নিরোধগামিনী প্রতিপদা জ্ঞানে কিভাবে দুঃখ-নিরোধ হয় সেপথ নির্দেশ করে দেয়। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান লাভের দ্বারা নানা যোনি অবলম্বনে ভবচক্রে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ হয়।
‘আমি মানুষ’ এই ধারণা মিথ্যা, ‘সে পুরুষ’ এই ধারণা মিথ্যা, ‘সে স্ত্রী’ এই ধারণা মিথ্যা। কাজেই মানুষ, পুরুষ, স্ত্রী এই সকল মিথ্যা ধারণা নিয়ে সুখভোগ করা ইচ্ছা পোষণ করো না। কারণ যা সত্য নয় মিথ্যা তা নিয়ে মশগুল না হওয়া এবং তাতে সুখভোগের আকাঙ্ক্ষা না করায় উত্তম। অজ্ঞ, মিথ্যা বা ভ্রান্তদৃষ্টি-সম্পন্নরা সুখভোগে রত থাকতে চায়। তারা আমি পুরুষ, সে স্ত্রী বলে একে অপরকে লাভ করতে ইচ্ছুক হয়। অর্থাৎ সেই স্ত্রী এবং আমি পুরুষ এই ধারণা করে করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি পুরুষ, সে স্ত্রী উভয় ধারণা মিথ্যা। এ জগতে ‘আমি আছি’ এ ধারণা মিথ্যা, ‘আমার আছে’ এ ধারণাও মিথ্যা। বস্তুতঃপক্ষে সমস্ত জগতই মিথ্যা, ভ্রান্ত, স্বপ্ন সদৃশ। একমাত্র চারি আর্যসত্য জ্ঞান, প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞানই সত্য এবং আসল।
শ্রদ্ধেয় বনভন্তে বলেন, কেহ যদি বলে আমি বৌদ্ধধর্ম বুঝতে চাই, তাহলে তাকে চারি আর্যসত্য, প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। বি.এ., এম.এ. পাশ তথা বড় বড় ডিগ্রী অর্জনের দ্বারা বৌদ্ধধর্ম বুঝা যায় না। চারি আর্যসত্য জ্ঞান লাভ, প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান লাভ হয়ে বুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করেই বৌদ্ধধর্ম বুঝতে হবে, অন্যথায় নয়। চারি আর্যসত্য জ্ঞান, প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান হল বুদ্ধজ্ঞান। চারি আর্যসত্য জ্ঞান অর্জন হলে পুনর্জন্মধারণ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ এই জ্ঞানের দ্বারা সংসারে জন্মগ্রহণ করে যে বিবিধ দুঃখভোগ করতে হয় সে দুঃখসমূহ জ্ঞাত হয়ে আর পুনর্জন্মগ্রহণের বাসনা, তৃষ্ণা থাকে না। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান লাভের দ্বারা এক ভব হতে অন্য ভবে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ হয়ে যায়। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি বা কার্যকারণ সম্বন্ধে অজ্ঞ ব্যক্তিরা ভবচক্রে ঘুরে ঘুরে মুক্তির পথ খোঁজে পাচ্ছে না। ভগবান বুদ্ধ বোধিমূলে প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান লাভ করত সংসারচক্রে পুনর্জন্ম বন্ধ হলে প্রফুল্ল চিত্তে আবেগপূর্ণ এই উদান গাথা উচ্চারণ করেছিলেন :
না পেয়ে যথার্থ চারিসত্যের দর্শন,
দীর্ঘকাল বহুযোনি করেছি ভ্রমণ।
এবার পেয়েছি সেই সত্যের দর্শন,
ভবনেত্রী, তৃষ্ণা এবে হয়েছে নিধন।
উৎপাটিত দুঃখ মূল তৃষ্ণার কারণ,
পুনর্ভব পুনর্জন্ম নাহিরে এখন।
সংসার বা ভবচক্রে পুনঃপুন জন্মগ্রহণ করা যে দুঃখ, মিথ্যাদৃষ্টি পরিবর্ধক ও পরিপোষক তা প্রকাশ করতে বুদ্ধ বক ব্রহ্মকে বলেছিলেন :
ভবে আমি দেখি ভব খুঁজিনু বিভব,
বিভব খুঁজিতে গিয়ে দেখিলাম ভব।
ভব অন্বেষণ তাই করি নাই আর,
ভব তৃষ্ণা ভবাসক্তি করি পরিহার।
স্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী মার্গলাভীর মিথ্যাদৃষ্টি আসব সমূলে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে কামাসব, ভবাসব, অবিদ্যাসব সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় না। অনাগামী মার্গলাভীর কামাসব, মিথ্যাদৃষ্টি আসব ধ্বংস হয়ে যায়; তবে তারাও ভবাসব, অবিদ্যাসব হতে সম্পূর্ণ মুক্ত নন। অর্হত্ত্বমার্গলাভীরা কামাসব, ভবাসব, দৃষ্টি আসব, অবিদ্যাসব হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। তারা চতুর্বিধ আসবকে সমূলে ক্ষয়, ধ্বংস সাধন করে থাকেন।
মার্গফল লাভেচ্ছুক প্রব্রজিতগণ হীনদৃষ্টি, পাপদৃষ্টি সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করবে। পাপদৃষ্টি উৎপন্ন হলে প্রব্রজ্যা ত্যাগ করে একজন সুন্দরী রমণীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করত সংসারী বা সাধারণ গৃহী অবস্থায় জীবন-যাপন করাকে সুখ বলে মনে হবে। আর হীনদৃষ্টি উৎপন্ন হলে প্রব্রজ্যা ত্যাগ করে চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা যেকোনো পেশা অবলম্বে ধর্ম-পুণ্য কর্ম করত একদিকে লৌকিক সুখ অন্যদিকে ধীরে ধীরে লোকোত্তর সুখে উন্নীত হবো এরূপ ইচ্ছা জন্মাবে। পাপদৃষ্টি, হীনদৃষ্টি ত্যাগ না করলে কেহ প্রব্রজিত অবস্থায় সুখে থাকতে পারে না। তোমরা পাপদৃষ্টি, হীনদৃষ্টি হতে সজাগ থাক এবং এরূপ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও যে, ‘আমরা পাপদৃষ্টি, হীনদৃষ্টি উৎপন্ন হতে দেবো না। পাপদৃষ্টি, হীনদৃষ্টি-সম্পন্ন চিত্তে কিছুতেই অবস্থান করবো না।’
অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান ত্যাগ কর। প্রব্রজিত হয়ে যদি অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদানের সহিত অবস্থান কর তাহলে বাংলাদেশে তৈরি রেডিও লেবেলে মেড ইন জাপান লেখা সদৃশ হবে। তোমরা যে কাষায় বস্ত্র পরিধান করেছ তা বাইরের লেবেলে মেইড ইন জাপান লেখেছ। অর্থাৎ অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদানের সহিত অবস্থান করব না এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছ। এখন যদি মনচিত্ত হতে অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান মূলোচ্ছেদ কর তাহলে প্রকৃত জাপানের তৈরি রেডিও হবে। মেড ইন জাপান রেডিও অর্থ প্রকৃত ভিক্ষু। বাংলাদেশে তৈরি কিন্তু লেবেলে মেড ইন জাপান লেখা অর্থ মিথ্যা ভিক্ষু, ছদ্মবেশী ভিক্ষু। বর্তমানে অধিকাংশ ভিক্ষুই অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান ত্যাগ করতে পারছে না। তারা বাংলাদেশের তৈরি রেডিও কিন্তু লেবেলে মেইড ইন জাপান লেখে অবস্থান করতেছে। অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান ত্যাগ করতে না পারলে দুঃখ পেতে হবে, দুঃখ থেকে মুক্ত হতে পারবে না, এমন কি নিরয়গামীও হতে পারে। অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান প্রহীন হলে দুঃখ হতে মুক্তি লাভ হয়। অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান প্রহীন করতে তোমাদেরকে শীত, উষ্ণ, ক্ষুধা, পিপাসা, ডংশ, মশক সহ নানাবিধ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে গভীর অরণ্যে ধ্যান সাধনা করতে হবে। ভগবান বুদ্ধ রাজার পুত্র হয়েও যদি ছয় বৎসর শীত, উষ্ণ, ক্ষুধা, পিপাসা, ডংশক, মশকের উপদ্রব সহ নানাবিধ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারেন তাহলে তোমরা কেন পারবে না? আমি যখন জঙ্গলে ছিলাম তখন বেশি দুঃখ অনুভব হলে বুদ্ধ, শারীপুত্র, মৌদ্গল্যায়ন, আনন্দ, মহাকাশ্যপ প্রমুখ মহাত্যাগীদের কথা স্মরণ করতাম। তাঁরা রাজার ছেলে, বড় বড় ধনী ছেলে হয়ে যদি কষ্ট সহ্য করতে পারেন আমি সাধারণ পরিবারের ছেলে হয়ে কেন পারব না? এরূপ ভেবে পুনঃ মনের মধ্যে বীর্য উৎপন্ন করতাম। আরো স্মরণ করতাম মহাজ্ঞানী শারীপুত্রের উপদেশসমূহ। শারীপুত্র বলেছিলেন :
চংক্রমণে, দাঁড়ানোতে হয়ে উপবিষ্টা,
বনে শোভা পায় ভিক্ষু, বন হয় প্রসংশিতা।
আপনার চিত্ত তুমি একাকী দমিবে,
বনান্তে সেইরূপ আনন্দ পাইবে।
সে-সকল উপদেশসমূহ বারবার স্মরণ করে আমি জঙ্গলের মধ্যে খুশী মনে অবস্থান করতে সক্ষম হতাম, উৎসাহিত হতাম। জঙ্গলের মধ্যে একাকী অবস্থানের জন্য দৃঢ়বীর্য উৎপাদন করতাম। তোমরাও মনচিত্ত থেকে অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান ত্যাগ করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হও। চিত্ত দমনের অনুকূল পরিবেশ জঙ্গলে প্রবেশ করে নিজের চিত্ত নিজে দমন করো। তাতে অবিদ্যা, তৃষ্ণা, উপাদান নিরোধ হওত বিমুক্ত সুখের অধিকারী হবে। তবে তোমরা যদি লাভ তৃষ্ণায় বশীভূত হয়ে থাক তাহলে বন জঙ্গলে অবস্থান করতে সমর্থ হবে না। বুদ্ধ বলেছেন, লাভ, তৃষ্ণায় বশীভূত হলে বন জঙ্গলে বাস করতে কষ্টকর মনে হয়। লাভ-তৃষ্ণা বশীভূত মনে বন-জঙ্গলে অবস্থান করলে মন দুঃখে পতিত হয়, কষ্ট পায়। তখন দুঃখ-কষ্টে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করা ছাড়া আর কিছুই হয় না। তোমরা যখন প্রব্রজিত হয়েছ দুঃখ কে ভয় কর, অকুশলে লজ্জা জ্ঞান উদয় কর। বুদ্ধের শাসনে প্রব্রজিত দুঃখকে ভয় করে সংসার দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করতে হয়। এ সংসার দুঃখে ভরা, এখানে সুখ বিন্দুমাত্র নেই এই ভেবে দুঃখজ্ঞান উদয় করতে হবে। প্রব্রজিত হয়ে যদি সংসার সুখ বলে দৃষ্ট হয় তাহলে প্রব্রজিত জীবনে কখনো শান্তি, সুখ লাভ হবে না। এবং তাদের নির্বাণ লাভের আশা হবে গুড়েবালি সদৃশ। বুদ্ধ বলেছেন, জগতে যত প্রকার দুঃখ পেতে হয় তৎ সমস্ত এ দেহধারণের দরুন। এই দুঃখদায়ক দেহধারণ না করলে দুঃখ কোথা হতে উৎপন্ন হবে। তাই জন্ম হলে দুঃখ পেতে হয়, দেহধারণে দুঃখ পেতেই হয়। তোমরা পুনর্জন্ম রোধ কর, দেহধারণ করা বন্ধ কর তাহলে নির্বাণ সুখ লাভ হবে।
পরিশেষে তিনি বলেন, তোমরা সম্যক সমাধি দ্বারা চারি আর্যসত্য জ্ঞান, প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান, আসবক্ষয় জ্ঞান অর্জন কর; তাতে তোমাদের প্রকৃত সুখ লাভ হবে। চারি আর্যসত্য জ্ঞানে দুঃখসমূহ যেমন দৃষ্টিগোচর হয় তেমনি দুঃখ-নিরোধের উপায়ও প্রদর্শিত হয়। প্রতীত্যসমুৎপাদ-নীতি জ্ঞান দ্বারা জন্মগ্রহণ তথা দুঃখের কার্য-কারণের হেতু নিরোধ হয়। আসবক্ষয় জ্ঞান দ্বারা ভাবী সংসারস্রাবের পথ রুদ্ধ হয়। আমি অভিজ্ঞ দ্বারা জানতে পারছি যে, বৌদ্ধধর্মে লোকোত্তরই একমাত্র সুখ। লৌকিক সুখ স্বপ্ন সদৃশ, প্রকৃতপক্ষে তা দুঃখই বলতে হয়। মারভুবন হল লৌকিক আর অমারভুবন হল লোকোত্তর। তোমরা মারভুবন ত্যাগ করে অমারভুবনে চলে যাও। মারভুবন অধীন, ভয়ঙ্কর, মুক্ত নেই, নিরাপত্তা নেই। পক্ষান্তরে অমারভুবন মুক্ত, সুখ, স্বাধীন, নির্ভয় ও নিরাপদ। স্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী, অনাগামী, অর্হত মার্গস্থ-ফলস্থ আর নির্বাণ এই নব লোকোত্তরধর্ম লাভ প্রকৃত সুখ ও নিরাপদ অবস্থা, যাকে অমারভুবন বলা হয়। অজ্ঞানী ব্যক্তিরা কিন্তু মারভুবন অমারভুবন কিছুই চিনে না। যেমন একটা গরু বনরূপাতে অবস্থান করলেও কি বনরূপা চিনে? বা বলতে পারে কি সে বনরূপায় আছে? ঠিক তদ্রূপ অজ্ঞানীর মনচিত্ত মারভুবনে অবস্থান করলেও তারা তা জানে না। এবং সে দুঃখ পাচ্ছে তাও সঠিকভাবে জানে না। কিন্তু জ্ঞানীরা এটা মারভুবন, এখানে দুঃখ আমি দুঃখের মধ্যে অবস্থান করবো না, বরং অমারভুবনে চলে যাবো এসবই তার জ্ঞানদৃষ্টিতে ধরা পড়ে। আবার, মারভুবনকে মৃত্যুরাজ্য, অমারভুবনকে অমৃত্যুরাজ্য বলে। তোমরা মারভুবন ত্যাগ করে অমারভুবনে চলে যাও, এবং মারভুবন, অমারভুবন, মৃত্যুরাজ্য, অমৃত্যুরাজ্য, ইহলোক, পরলোক, চিত্ত সংযম ও শমথ-বিদর্শন সম্বন্ধে দক্ষতা অর্জন কর। এসব সম্বন্ধে দক্ষতা লাভ হলে নির্বাণ সুখ প্রত্যক্ষ হয়। দক্ষতা লাভ করার অর্থ জ্ঞানী পণ্ডিত হওয়া; তোমরা জ্ঞানী, পণ্ডিত হও; দিনে দিনে পাণ্ডিত্য অর্জন কর। পণ্ডিতেরা মারের প্রলোভনে প্রলুব্ধ না হয়ে জগতের কোনো বিষয়ের প্রতি রমিত হন না।
তোমরা নির্বাণের মন, নির্বাণের চিত্ত হয়ে অবস্থান কর। নির্বাণের মন, নির্বাণের চিত্ত হলে নির্বাণ লাভ হয়। প্রব্রজ্যা ত্যাগ করার মন, বিয়ে করার মন, চাকুরি করার মন হলে নির্বাণ হতে শত সহস্র মাইলের দূরে থাকতে হবে। কোনো মতে আর নির্বাণের কাছে পৌঁছতে সম্ভব হবে না। নির্বাণ যেতে হলে নির্বাণের মন, নির্বাণের চিত্ত হয়ে অবস্থান করতে হয়।
সাধু, সাধু, সাধু।